জেনারেল ইয়াহিয়া খান এখন ঝিম্ ধরেছেন। বাঙালি জাতিকে পদানত করবার সমস্ত প্ল্যান আর ফমূলা বানচাল হয়ে যাওয়াতেই জেনারেলের এই অবস্থা হয়েছে। বাংলাদেশে। বর্বর আক্রমণ শুরু করবার পর পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একেবারে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হওয়াতে সেনাপতি ইয়াহিয়া এখন চেখে সরিষার ফুল দেখতে পাচ্ছেন। চারপাশটা কেমন যেন হদে হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া তরল জাতীয় পদার্থের মাত্রাধিক্য ঘটায় তাঁর চোখের সামনে সবকিছু যে ঝাপসা হয়ে আসছে। এখন তিনি ভুট্টো সাহেবকে
৩৬
চেনার ভান করছেন। বেচারা ভুট্টো সেদিন করাচীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে আফসােস করে বলেছেন যে, ইসলামাবাদের এখনকার কায়-কারবার পিপলস পার্টির অজ্ঞাতেই চলছে। অথচ আগের ওয়াদামতাে আওয়ামী লীগ বেআইনী ঘােষণা করার পর পিপলস পার্টিকেই ৩০শে জুলাই-এর মধ্যেই ক্ষমতা দেয়ার কথা। ক্ষমতার লােভে ভুট্টো সাহেব এখন ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দিয়েছেন। কিন্তু ভুট্টো সাহেব একটা কথাষড়যন্ত্র রাজনীতিতে যার জন্ম ষড়যন্ত্রের মধ্যেই যে তার মৃত্যু! তাই এখন আর কাউ কাউ করে লাভ কি?
এদিকে আগায় খান পাছায় খান- খান আব্দুল কাইউম খান আবার খুলেছেন, মাফ করবেন মুখ খুলেছেন। তিনি আবদার করেছেন। আবার আদমশুমারী করে নির্বাচন করতে হবে। অবশ্য তিনি ইসলামাবাদের সামরিক কর্তৃপক্ষকে আরও ক’টা দিন সবুর। করতে বলেছেন। কেননা দন্তবিহীন সীমান্ত শার্দুল’- খান কাইউম খান পরিস্কারভাবে ঘােষণা করেছেন যে, বাংলাদেশ থেকে আরও কিছু বাঙালিকে উচেচ্ছদ করবার পর আদমশুমারী ও নির্বাচন করতে হবে। আয় মেরে জান, পেয়ারে দামান, খান কাইউম খান, তােমার ক্যারানী আর কত দেখাবে? মনে নেই তুমি যখন সীমান্ত প্রদেশের পেরধান মন্ত্রী ছিলে, তখন সেখানকার সাধারণ নির্বাচনে তােমার মনােনীত প্রার্থীরা এক একটা এলাকায় মােট ভােটার সংখ্যা থেকেও বেশি ভােট পেয়েছিল? কিন্তু সত্ত্বরের নির্বাচনে তােমার মুরুব্বী পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে যে নির্বাচন হয়েছে তাতে বাংলাদেশে তােমার পার্টির প্রার্থীদের অবস্থা একেবারে ছেছুছেরা হওয়াতেই কি তােমার উর্বর মস্তিষ্কে নতুন প্ল্যান গজাচ্ছে? কি বুদ্ধি তােমার? এত বুদ্ধি নিয়ে রাতে তুমি ঘুমাও কেমন করে?
জামাতে ইসলামীর জেনারেল সেক্রেটারী তােফায়েল আহমদ আরও এক ডিগ্রি এগিয়ে গেছেন। ইনি ধূয়া তুলেছন প্রথম নির্বাচনের ভিত্তিতে আবার সাধারণ নির্বাচন করতে হবে। এ যেন বাচ্চা মেয়েদের এক্কা দোক্কা খেলা আর কি? থুক্কু দিলেই- ফেন পহলেসে। কিন্তু তােফায়েল আহমদ ভাইয়া; sorry মাওলানা তােফায়েল, পশ্চিম পাকিস্তানে আপনারা যা খুশি তাই করতে পারেন; আপনাদের খাসী ইচ্ছে করলে আপনারা লেজ দিয়ে জবাই করতে পারেন- তাতে আমাদের কিস্সু যায় আসে না। কিন্তু দোহাই আপনার, বাংলাদেশের ব্যাপারে আর মাথা গলাবেন না।
এবারের সাধারণ নির্বাচনে তাে আপনাদের Candidate দের অবস্থাটা দেখেছেন? এমনকি মীরপুর-মােহাম্মদপুরের অবাঙ্গালি এলাকা থেকেও আপনার জামাতে ইসলামীর মাইনে করা আমীর গােলাম আজম পর্যন্ত ধরাশায়ী হয়ে পড়লেন। বাংলাদেশের মাটি খুবই পিছলা কিনা? কয়েক কোটি টাকা খরচ করার পরেও তাে একজন প্রার্থীও নির্বাচিত করাতে পারলেন না। এই দুঃখেই কি এখনও পর্যন্ত সিনা চাপড়াচ্ছেন?
কিন্তু এদিকে যে, আপনাগাে নেতা সেনাপতি ইয়াহিয়া এখন উল্টা-পাল্টা কথা বলতে শুরু করেছেন। সেদিন ভট করে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেই বসলেন, শেখ মুজিব আমাকে গ্রেফতার করতে চেয়েছিলেন। সম্মেলনে হাজির থাকলে বলতাম, একটু আস্তে কন। ঘােড়ায় হুলে হাইস্যা দিবাে। শুধু এখানেই শেষ নয়, ইয়াহিয়া চমৎকার
৩৭
ভাষায় বাংলাদেশের শরণার্থীদের হানাদার দখলকৃত এলাকায় ডেকে পাঠিয়েছেন। সেকি করুণ আবেদন! বাঙালির দরদে তার দু’চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় পানি পড়িয়ে পড়লাে। তিনি বাঙালি শরণার্থীদের হানাদার দখলকৃত এলাকায় ফিরে আসার আহ্বান জানালেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর এক শ্রেণীর অবাঙালি রাজাকার এসব বাঙালিদের মদত্ করবে। কিন্তু মদ জিনিষটা যে কি, তা বাঙালিরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছে। তাই সেনাপতি ইয়াহিয়ার কথায় কেউই কান দিলাে না। এদিকে লন্ডন টাইমস পত্রিকা আবার ভাণ্ডা ফুটা করে দিয়েছে। এ পত্রিকায় ২৬শে মে তারিখের এক খবরে বলা হয়েছে যে, জেনারেল ইয়াহিয়া যখন বাঙালি শরণার্থীদের ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন, ঠিক তখই হানাদার সৈন্যরা সাতক্ষীরা সীমান্তে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে আসা নিরস্ত্র বাঙালি শরণার্থীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে।
ইয়াহিয়া সাহেব জ্ঞানপাপী। যে মুহূর্তে তিনি খবর পেয়েছেন যে বাংলাদেশে ছলে বলে কৌশলে কিছু নির্বাচিত সদস্য জোগাড় করে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলেই, পশ্চিমা দেশগুলাে থেকে আবার সমস্ত রকমের সাহায্য পাওয়া যাবে, সেই মুহূর্তেই তিনি ভােল পাল্টে ফেললেন। গেল ২৬শে মার্চ যে আওয়ামী লীগকে তিনি রাষ্ট্রের শত্রু, দেশের শত্রু আখ্যায়িত করে চৌদ্দ পুরুষের বাপান্ত করে ছেড়েছিলেন; এখন আবার সেই আওয়ামী লীগের মাঝ থেকে কিছু কিছু দেশপ্রেমিক সদস্যদের খুঁজে বের করার। হুকুম জারি করে পো-ধরা নেতাদের ভুলতে বসেছেন। কিন্তু দিন দুয়েকের মধ্যেই আবার ইসলামাবাদে ঘােরতর দুঃসংবাদ এসে পৌছলাে। বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকা থেকে দালালী করবার মতাে জনা আড়াই-এর বেশি নির্বাচিত সদস্য পাওয়া যায়নি। বাকি সদস্যরা সব একেবারে গায়েব হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে হানাদার সৈন্যরা এখন মুক্তিফৌজের গেরিলা মাইরের মুখে একেবারে পাগলা হয়ে গেছে। জেনারেল ইয়াহিয়া, তােমাকে একটা কথা বলতে চাই। হা-ডু-ডু খেলা দেখেছাে কখনাে? সেই হাডু-ডু খেলায় কেচকি বলে একটা প্যাচ আছে। বাংলাদেশে তােমার হানাদার বাহিনী এখন। সেই কেচকিতে পড়েছে। আর তুমি বুঝি হেই কেচ্কির খবর পাইয়া আউ-কাউ কইর্যা বেড়াইতাছাে। তাই বলেছিলাম- জেনারেল ইয়াহিয়া এখন ঝিম্ ধরেছেন।