চড়ারহাট বধ্যভূমি ও গণকবর
১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর। দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার চড়ারহাট এবং এ গ্রামের লাগোয়া গ্রাম আন্দোল-এ ৯৮ জন সাধারণ গ্রামবাসীকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা।
নবাবগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুর রহমান জানান, চড়ারহাট (প্রাণকৃষ্ণপুর) গ্রামের ২ জন মহিলাসহ ৬৭ জন ও পার্শবর্তী আন্দোল গ্রামে ৩১ জন গ্রামবাসী সেদিন পাক সেনাদের গুলিতে মারা যান।
চড়ারহাট প্রাণকৃষ্ণপুরে পুরুষদের একত্রিত করে গ্রামের পুবদিকের শেষ প্রান্তে একটি বীজতলায় এই হত্যাযজ্ঞ চালান হয়। আন্দোল গ্রামে পাক সেনারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরুষদের গুলি করে হত্যা করে। ঐদিন পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিবর্ষণ থেকে চড়ারহাট গ্রামের আটজন গুলিবিদ্ধ হয়েও প্রানে বেঁচে যান। তাদেরই একজন শহীদ মনছের আলীর ছেলে চড়ারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. মোজাম্মেল হক (৬৩)। সেদিন তিনি পাক সেনাদের হাতে তার বাবা এবং ছোট ভাই মকবুল হোসেনকে হারান।
মোজাম্মেল হক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জানান, সেদিন তিনি ভোরে ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে যান। মসজিদে ১০/১২ জন নামাজ পড়ছিলেন। নামাজ শেষে গ্রামের প্রবীন ব্যক্তি মফিজ উদ্দিনসহ অনেকেই খবর দেন যে, ভাঙ্গা সেতু নির্মাণ করতে মাটি কাটতে ডাকছে পাক সেনারা। পাক সেনাদের কথা শুনে বুকটা কেঁপে ওঠে। কিন্তু মুরুব্বিদের আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে সকলেই আমরা গ্রামের পুব দিকে একটি মাঠে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি গ্রামের প্রায় সকল পুরুষ মানুষকে এসেছে। এরপর পাক সেনারা তাঁদের ওপর নির্বিচারে ব্রাশ ফায়ার করে। তিনি বাম পা ও ডান হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
পাক সেনাদের গুলিতে বেঁচে যাওয়া অপরজন ডা. ইয়াহিয়া সরকার জানান, নামাজ শেষে তিনি বাসায় জায়নামাজে বসে ছিলেন। এমন সময় তার বড় ভাই ইউনুছ সরকার ও মফিজ উদ্দিন তাকে ও তার ছোট ভাই একরামুল হক সরকারকে পাক সেনাদের সঙ্গে মাটি কাটতে হবে বলে ডেকে নিয়ে যান। পাক সেনাদের গুলিতে তারা তিন ভাই গুলিবিদ্ধ হলেও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।
গ্রামের শহীদ আবদুল গফুরের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “মসজিদে আশ্রয় নেওয়া পুরুষরা বেঁচে যান। কিন্তু পাক সেনারা বাড়ি বাড়ি তল্লাশী করে যে সকল পুরুষ পেয়েছে তাঁদেরকে সেখানেই গুলি করে মেরে ফেলে। আমার বাবা ও মামা তছির উদ্দিনকে আমাদের বাড়ির সামনেই মেরে ফেলে। পাক সেনারা এ গ্রামের ৩১ জন পুরুষকে হত্যা করে”।
নবাবগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুর রহমান বলেন, এ অঞ্চলের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম ঘটনা চড়ারহাট গণহত্যা। অথচ এ শহীদরা পায়নি কোনো মর্যাদা। ৪০ বছর পর ২০১১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।
তবে এ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনায় অন্যত্র বলা হয়েছে ১০ অক্টোবর দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ থানার চড়ারহাট ও আন্দোল গ্রামে পাক হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে ১৫৭ জন শহীদ হন। ৯অক্টোবর রাতে পাকসেনারা চড়ারহাট ও আন্দোল গ্রাম ঘেরাও করে। অস্ত্রের মুখে এই দুটো গ্রামের সকল পুরুষকে একত্র করা হয়। দলার দরগা নামক স্থানে ভেঙ্গে পড়া কালভার্ট মেরামতের কথা বলে তাঁদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের। অনেক কবরে একই সঙ্গে ৪/৫টি করে মৃতদেহ দাফন করা হয়। এই ঘটনায় বেঁচে থাকা বিশ্বাস হয় না যে খান সেনাদের নির্মম গুলিবর্ষণের পরও তিনি বেঁচে আছেন। গুলিবর্ষণের ঘটনায় প্রায় ৪ ঘন্টা পর লাশের স্তূপের ভিতর থেকে গ্রামের মহিলারা মাজেদকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্য সূত্রঃ যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩১৩; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, দ্বিতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-১০৭-১০৮)