ঢাকার সংবাদপত্রগুলাের এখন কুফা অবস্থা। পাঞ্জাবের মেজর সিদ্দিক সালেক এ সমস্ত দৈনিক পত্রিকাগুলাের প্রধান সম্পাদকের আসন অলঙ্কৃত করে রয়েছে। কেননা এই মেজর সালেকই হচ্ছেন বাংলাদেশে হানাদার বাহিনীর আর্মি পি.আর.ও। ঢাকার
৩২
সংবাদপত্র ছাড়াও বেতার টিভির উপর তার দোর্দণ্ড প্রতাপ। মেজর সালেক প্রত্যেকটি সংবাদের উপর সেন্সরড ও পাণ্ড সিল দিয়ে দস্তখত করলে খবরের কাগজগুলাে তাছাপাতে পারছে। অবশ্য তিনটা পত্রিকার সম্পাদকের এতে কিসসু যায় আসে না। কেননা এরা দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক হওয়া সত্ত্বেও কোনাে দিনই সম্পাদকীয় নিবন্ধ লেখেন নি। তাই বলে ভাববেন না যে, এ দু’জনের লেখার ক্ষমতা অদ্ভূত- কেবল ইচ্ছে করেই লিখছেন না। আসলে এরা দু’জন ঐ লেখার বিদ্যেটা ছাড়া আর সব কিছুতেই পারদর্শী। এদের একজনের আদি নিবাস ভারতের বিহার প্রদেশে। নাম- এস.জি.এম. বদরুদ্দিন। ইনিই হচ্ছেন পাকিস্তান সরকার পরিচালিত প্রেস ট্রাস্ট মালিকানার ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকার সম্পাদক। মাস কয়েক আগে এই বদরুদ্দিনই মর্নিং নিউজের ঢাকা ও করাচী এ দু’টো এডিশনের প্রধান সম্পাদকরূপে নিযুক্ত হয়েছেন। এর কৃতিত্ব হচ্ছে, গত পনেরাে বছরের মধ্যে ইনি কোনাে সম্পাদকীয় নিবন্ধ লেখেননি। বিদ্যার দৌড় পেটে বােমা মারলে বােমাটাই ভোঁতা হয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু তবুও ইনি ইংরেজি মর্নিং নিউজ পত্রিকার সম্পাদক। তাহলে এর আর কি কি যােগ্যতা রয়েছে? প্রথমতঃ ইনি হচ্ছে উর্দুভাষী- আঠার বছর ঢাকায় বসবাস করা সত্ত্বেও বাংলা বলতে বা পড়তে পারেন না। দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল অর্থাৎ পাকিস্তান আর্মির এজেন্ট। আর তৃতীয়তঃ ইনি একটু তরল জাতীয় পদার্থ পানে অভ্যস্ত।
আরেকজন সম্পাদক ফেনী নিবাসী বঙ্গভাষী। কেবলমাত্র লেখার বিদ্যাটা ছাড়া ইনি সমস্ত রকমের বিদ্যায় পারদর্শী। ইনি একদিকে শ্রমিক নেতা ও রাজনীতিবিদ। অন্যদিকে ইনি একজন টাউট সম্প্রদায়ের লােক। ইনিই হচ্ছেন পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকার বাংলা সংস্করণ দৈনিক পূর্বদেশের সম্পাদক মাহবুবুল হক। আজ পর্যন্ত জনাব হক। পূর্বদেশ পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধ লেখা তাে দূরের কথা, একটা মফস্বল সংবাদ পর্যন্ত লিখতে পারেননি। অর্থাৎ কিনা লেখার ক্ষেমতা নেই। তবে হ্যা ইনি একজন শ্রমিক নেতা। রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগের সভাপতি হিসেবে বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনে ইনি যেভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন,তা মীরজাফরকেও হার মানিয়ে দেয়। এই মাহবুবুল হকের বদৌলতেই বাংলাদেশের রেলওয়ে কর্মচারীরা তাদের ন্যূনতম অধিকার পর্যন্ত আদায় করতে পারেনি।
জনাব মাহবুবুল হক একজন রাজনৈতিক নেতাও বটে। ইনি মনেপ্রাণে একজন খাটি জামাতে ইসলামী। অবশ্য নামাজ রােজার বালাই পর্যন্ত নেই। কিন্তু বন্ধু সমাজে ইনি নিজেকে প্রগতিশীল বলে দাবি করে থাকেন। সত্তুরের সাধারণ নির্বাচনে জনাব হক তার মুনিব আর পাকিস্তানের ক্লিক রাজনীতির সদস্য হামিদুল হক চৌধুরীর নির্দেশে। ফেনীর একটা আসন থেকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
জনাব মাহবুব ফেনীতে খুবই জনপ্রিয় কিনা! তাই মাত্র হাজার খানেক ভােটের জন্য তার জামানতটা রক্ষা পেয়েছে। তার সবচেয়ে বড় যােগ্যতা হচ্ছে, তিনি পাকিস্তান আর্মির খুবই আস্থাভাজন লােক। মেজর সালেকের মতাে লােকদের সংগে তার বহু আগে থেকেই নিবিড় সম্পর্ক ছিল। অবশ্য বিদেশী দূতাবাসের লােকদের সংগে তার দহরম
৩৩
মহরম রয়েছে।
এছাড়া দৈনিক পাকিস্তানের সম্পাদকের কথা না-ই বা বললাম। এই পত্রিকার সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দিন অনেকদিন আগে থেকেই নিজেই নিজেকে চিঠিপত্র লিখছেন। অর্থাৎ কিনা পত্রিকার সম্পাদকীয় লেখার ব্যাপারটা উনি জুনিয়রদের উপর ছেড়ে দিয়ে সম্পাদকের কাছে চিঠিপত্র লেখার দায়িত্ব নিয়েছেন। সে এক অদ্ভূত ব্যাপার! রােজ এই বৃদ্ধ দ্রলােক দোতলার কোণার ঘরটাতে বসে চিঠিপত্র তৈরী করছেন আর নিজের পত্রিকায় ছাপাচ্ছেন।
তাই বলছিলাম, ঢাকার পত্রিকাগুলাের এখন এক কুফা অবস্থা। এসব সংবাদপত্রগুলাে এখন হানাদার বাহিনীর কুক্ষিগত। হানাদার বাহিনীর তাবেদাররাই এখন সংবাদপত্রগুলাে নিয়ন্ত্রণ করছে। অবশ্য যে ক’টা দৈনিক পত্রিকা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কথা ছাপাতাে সেসব পত্রিকাগুলাের ছাপাখানা, মায় অফিস ভবন পর্যন্ত কামানের গােলায় নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। আর এদিকে দালাল মার্কা সংবাদপত্রগুলাে চার থেকে ছ’পৃষ্ঠায়লা ইস্যু বের করে দালালীর প্রতিযােগিতা করছে। এরা কয়েকটা জায়গায় স্টাফ রিপাের্টার পাঠিয়ে অবস্থা স্বাভাবিক’ বলে খবর ছাপানাের প্রচেষ্টা করছে। কিন্তু কি লাভ? এখন ঢাকায় গড়ে একটা খবরের কাগজের প্রচার সংখ্যা এক থেকে দেড় হাজারের মতাে। কেননা ঢাকায় কাগজ কেনার মতাে লােক কই? আর মফস্বলের সঙ্গে ঢাকার তাে কোনাে যােগাযােগ ব্যবস্থাই নেই। অবজার্ভার গ্রুপ অব পাবলিকেশন্স এর মধ্যেই তাে ছাটাই-এর নােটিশ দিয়েছে।
তাই ঢাকার পত্রিকাগুলাের সুপ্রিম সম্পাদক মেজর সালেকের কাছে একটা আরজ, যে কোনাে একটা খবরের কাগজের ছাপাখানা থেকে তাে সমস্তগুলাে কাগজই ছাপার। ব্যবস্থা করা যায়। কেবল এক দেড় হাজার করে ছাপা হবার পর কাগজের নামের হেড পিটা বদলে দিলেই তাে চলে। খামােখা প্রতিদিন তকলিফ করে জিপে চড়ে প্রত্যেকটা খবরের কাগজ অফিসে ঘুরে বেড়াবার কষ্ট করছেন। পালের গােদা হামিদুল হক চৌধুরীর। কাছ থেকে একটা advice নিন। কাজ দিবে। এই চৌধুরী সাহেবের advice ই তাে। পূর্বদেশের প্রেস ম্যানেজার আহসান উল্লাহ সেদিন কল্যাণপুরে বাসার অবস্থা দেখতে যেয়ে বিহারীদের হাতে নিহত হলাে। পরে লাশ উদ্ধার করে অফিসে নিয়ে আসলে চৌধুরী সাহেব শুধু একটা কথাই বলেছিলেন, “ভালাে করে লাশ সনাক্ত করেছাে তাে? লাশটা কি ঠিকই আহসান উল্লার?”…হত্যাকারী কাকে বলবাে?