খুনিয়াদীঘি বধ্যভূমি
জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি খুনিয়া দিঘী। শত্রু বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রায় ৩ হাজার মানুষকে ধরে এনে খুনিয়াদিঘী নামক পুকুর পাড়ে হত্যা করে তাঁদের লাশ পুকুরের পানিতে ভাসিয়ে দেয়। ১৯৭২ সালে এখানে তৈরি করা হয় একটি স্মৃতিসৌধ।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ঠাকুরগাঁও এর সীমান্ত এলাকা রানীশংকৈল, হরিপুর ও বালিয়াডাঙ্গী এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা তৎপরতায় পাকবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। পাক বাহিনী রানীশংকৈলে স্থাপন করে একটি ক্যাম্প। সে সময় তাঁদের সহযোগিতা করে মালদাইয়া বলে কথিত স্বাধীনতা বিরোধী এক শ্রেণীর লোক। এঁদের সহযোগীতায় তারা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের লোকজন ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে হাজির করত মেজর তাজ বলে পাকিস্তানি মেজরের সামনে। তার নির্দেশে বাঙালিদের খুনিয়া দিঘির পাড়ে জড়ো করা হতো। ভাণ্ডারা গ্রামের খুনিয়া দিঘির পাড়ে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হতো তাঁদের। দিঘির পানিতে লাশ ফেলে দেওয়া হতো অথবা পাড়ের উঁচু জমিতে মাটি চাপা দেওয়া হতো। একদিন পাক বাহিনী ১৮ জন বাঙালিকে এক সঙ্গে গুলি করে লাশ দিঘিতে ফেলে দেয়। এঁদের মধ্যে ১ জন প্রাণে বেঁচে যান। সারাদিন দিঘির কচুরিপানার মধ্যে মাথা ভাসিয়ে বেঁচে থাকেন তিনি। রাতে লাশ ঠেলে পাড়ে উঠে কোন মতে ভারতে পালিয়ে যান। কয়েক হাজার বাঙালিকে এখানে হত্যা করা হয়। খুনিয়া দিঘির আশেপাশের বাড়িঘর থেকে ধরে এনে যাদের হত্যা করা হয় তাঁদের মধ্যে রয়েছেন খোকা, দবিরুল, কুরমন, বসির উদ্দিন ও সাইফুদ্দিন। রাণীশংকৈল উপজেলার সন্ধ্যারই গ্রামের পবার আলী ও বনগাও গ্রামের নুরুল ইসলাম জানান, ৩ হাজার বাঙালিকে এই খুনিয়া দিঘিতে হত্যা করা হয়। তবে অনেকের অনুমান এই সংখ্যা আরও বেশি। স্বাধীনতার পর এই আত্মত্যাগের নির্মম ইতিহাসের সে সব শহীদের কথা স্মরন করে দীঘির পারে তৈরি হয় স্মৃতিসৌধ।
অন্যান্য সূত্রেও এটির উল্লেখ রয়েছে-রাণীশংকৈল থানায় পাকসেনাদের ক্যাম্পে রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের সহযোগিতায় ধরে আনা হতো অগণিত বাঙালিকে এবং নির্যাতনের পর হত্যা করে খুনিয়াদীঘিতে ফেলে দেওয়া হতো। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, তিন হাজারেরও বেশি বাঙালিকে হত্যা করে খুনিয়াদীঘিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। খুব কম লাশই তারা মাটি খুঁড়ে গর্তে পুঁতে রাখতো। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্য সূত্রঃ একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর-সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৯৪; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৪১২; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, দ্বিতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-৬৩; মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর-অংশগ্রহনকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ, সুকুমার বিশ্বাস সম্পাদিত, পৃ.-৩১-৩২)
হরিপুর পাকবাহিনীর ক্যাম্পের বধ্যভূমি
হরিপুর উপজেলার সাইফুদ্দিন, মহিরউদ্দিন, নুরুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম, মজিবর রহমান ও তার ভাই এবং হরিপুর মসজিদের ইমামসহ প্রায় শতাধিক ব্যক্তিকে হরিপুর পাকবাহিনীর ক্যাম্পে ধরে আনা হয়। কিন্তু সেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসেনি। এখানে স্মৃতিসৌধ তৈরি করা হয়নি।
অন্যসূত্রে আছে-সন্তান মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় সদর থানার ফারা বাড়ির শেখ শহর আলী ও তার ভাই শেখ বাহার আলিসহ ১৯ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে ১৫ মে পাক বাহিনী তাঁদের ক্যাম্পে ধরে আনে এবং গুলি করে হত্যা করার পর মৃতদেহগুলো একটি গর্তে মাটিচাপা দিয়ে রাখে। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্য সূত্রঃ একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর-সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৯৪; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৪১২; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, দ্বিতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-৬৩; মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর-অংশগ্রহনকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ, সুকুমার বিশ্বাস সম্পাদিত, পৃ.-৩১-৩২)