সামরিক সাহায্যের বদৌলতে আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অবস্থা এখন একেবারে ছেরাবেরা হয়ে গেছে। বাংলাদেশে স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে পদানত করতে যেয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এরকম একটা বিপর্যস্ত অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। কুর্মিটোলা, ময়নমতী, যশাের, চট্টগ্রাম আর রংপুরের সামরিক ছাউনী এলাকার গােরস্তানগুলাে পাকিস্তানের হানাদার জওয়ানদের কবরে ভরে গেছে। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে বহু হানাদারের লাশ সগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এদিকে ঢাকা থেকে প্রতিদিনই পিআইএ বিমানে নিহত পাকিস্তানী সামরিক অফিসারদের কফিন পশ্চিম পাকিস্তানে আত্মীয়স্বজনদের কাছে পাঠানাে হচ্ছে। লাহাের, সারগােদা, লায়ালপুর, মুলতান, শিয়ালকোট, কোহাট, পেশােয়ার, কোয়েটা, লারকানা, শুকর প্রভৃতি এলাকায় এসব কফিন যেয়ে পৌছানাের। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঘরে কান্নার রােল পড়ে গেছে।
মাত্র দু’মাসের লড়াইয়ে বাংলাদেশে হানাদার পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অফিসারসহ কয়েক হাজারের মতাে জওয়ান নিহত হয়েছে। এছাড়া বিপুল সংখ্যক পাক সৈন্য আহত হয়েছে। তাই আজ বাংলাদেশে হানাদার অধিকৃত শহরগুলােতে রােজই সামরিক বাহিনীর এম্বুলেন্স রক্ত সংগ্রহের জন্যে টহল দিচ্ছে।
মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বেপরােয়া হত্যালীলা চালিয়ে জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল মিঠা খান আর জেনারেল পীরজাদার দল বাংলাদেশকে পদানত করবার যে স্বপ্ন দেখেছিল, তা আজ ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে। সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা তৎপরতায় হানাদার সৈন্যের দল অস্থির হয়ে উঠেছে। অতর্কিত আক্রমণে প্রতিদিনই উল্লেখযােগ্য সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হচ্ছে। এমন কি খােদ ঢাকা শহরের আর্মানীটোলায় আর কুর্মিটোলার অদূরে আজমপুর গ্রামে টহলদারী পাক সৈন্যদের দল নিশ্চিহ্ন হয়েছে।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে কুর্মিটোলার সামরিক ছাউনীতে শােকের ছায়া নেমে এল। একদল সৈন্য গার্ড অব অনার দেখাবার জন্য প্রস্তুতি নিলাে। আখাউড়া সেক্টর থেকে হানাদারদের গােটা কয়েক সাঁজোয়া গাড়ি মন্থর গতিতে কুমিল্লা আর ময়নামতীর উপর দিয়ে দাউদকান্দি হয়ে ঢাকার দিকে এগিয়ে এল। কাচপুরের ফেরি পার হয়ে বাওয়ানী মিলের পাশ দিয়ে যাত্রাবাড়ীর মাঝ দিয়ে ঢাকা নগরীর হাটখােলায় প্রবেশ করলাে। প্রায় জনশূন্য ঢাকার রাস্তায় দু’চারজন পথচারী কনভয়টা মন্থর গতিতে এগিয়ে। যাওয়ায় অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলাে। প্রথম গাড়িটার উপর পাকিস্তানী পতাকা দিয়ে ঢাকা একটি কফিন। এর পেছনে বাকিগুলােতে সৈন্য বােঝাই রয়েছে।
৩১
কনভয়টা ধীরে ধীরে বিধ্বস্ত ঢাকা নগরীর মাঝ দিয়ে মন্থর গতিতে এগিয়ে গেল। মাঝে মাঝে রাস্তার দু’ধারে টহলদারী সৈন্যরা এ্যাটেনশন পজিশনে’ স্যালুট দিয়ে সম্মান দেখাচ্ছে। শেষ অবধি কনভয়টা এয়ারপাের্ট হয়ে কুর্মিটোলার সামরিক ছাউনিতে গিয়ে হাজির হলাে। সমগ্র এলাকায় নীরবতা নেমে এল। এরপর শুরু হলাে আনুষ্ঠানিক সম্মান প্রদর্শন।
আবার কনভয়টা এগিয়ে চললাে তেজগা বিমান বন্দরের দিকে। বিমান বিধ্বংসী কামান, মর্টার, ট্রেঞ্চ আর বাংকার দিয়ে ঘেরাও করা বিমান বন্দরে যখন কনভয়টা গিয়ে পৌছলাে তখন বিকেলের পড়ন্ত রােদ এসে দাঁড়িয়ে থাকা পিআইএ বিমানের উপর পড়ে চক চক করছিল। এমন সময় জেনারেল মিঠা খান এসে কফিনে রাখা লাশটার প্রতি সম্মান দেখালাে। একটু পরেই বিমানটা স্বদেশে রওনা হলাে।
এই বিমানেই ফিরে গেলেন পাকিস্তান আর্টিলারী ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার নওয়াজেশ আলী। তিনি করাচী হয়ে লাহােরে তাঁর স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের মাঝে ফিরে গেলেন। তবে জীবিত অবস্থায় নয়। ঐ কফিনটাতেই নওয়াজেশের লাশ রয়েছে। আখাউড়া সেক্টরে তিনি যখন একটা জিপে করে রুটিন-ভিজিটে বেরিয়েছিলেন, তখন অসীম সাহসী মুক্তিযােদ্ধারা একটা ঝােপের আড়ালে বসে তাঁকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। শুধু নওয়াজেশ কেন, গত দু’মাসে পাকিস্তান আর্মির বেশ কিছু কমিশন্ড অফিসারের লাশ বিমানযােগে দেশে পাঠানাে হয়েছে। অবশ্য যে হাজার কয়েক আর্মি জওয়ান এর মধ্যেই বাংলাদেশে নিহত হয়েছে তাদের লাশ তাে আর স্বদেশে পাঠানাের প্রশ্ন ওঠে না। ওদের লাশ বাংলাদেশেই দাফন করা হচ্ছে। এছাড়াও গত দু’মাসে কয়েক হাজার পাক সৈন্য মুক্তিফৌজের হাতে প্রচণ্ড মারের মুখে আহত হয়ে কাতরাচ্ছে।
এদের জন্যে বাংলাদেশের বেসামরিক লােকদের জোর করে ধরে ধরে রক্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। কিন্তু তবুও পাকিস্তান আর্মি বাংলাদেশে আর হালে পানি পাচ্ছে না। পাকিস্তানের মােট তেরাে ডিভিশনের মধ্যে চার ডিভিশন সৈন্য বাংলাদেশে লড়াই করছে। কাশ্মীর ও পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকা থেকে আর সৈন্য উঠিয়ে বাংলাদেশে আনা সম্ভব নয়। এদিকে বাংলাদেশেও দ্রুত সৈন্য ক্ষয় হচ্ছে। তাই এখন সেনাপতি ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মিলিশিয়া বাহিনীদের কাফের নিধনের কথা বলে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। কিন্তু এখানে যুদ্ধ জয়ের কোনাে আশা নেই দেখে আর মুক্তিফৌজের গেরিলা যুদ্ধের দাপটে এদের মনোেবল একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে। তাই বলছিলাম বাংলাদেশে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর অবস্থা একেবারে ছেরাবেরা হয়ে গেছে।