পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমি
জয়পুরহাট জেলা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পূর্বে পাগলা দেওয়ান গ্রাম। তার আশেপাশে চক বরকত, খাস পাহনন্দা, চিরলাসহ কয়েকটি ভারত সীমান্তবর্তী গ্রাম। এই গ্রামগুলোয় ’৭১ এর এপ্রিল থেকে নজর রাখতে শুরু করে হানাদাররা। যুদ্ধের সময় তখন টগবগে তরুণ চিরলা গ্রামের আবু সালেম মিয়া জানান, “ভাবলাম কয়েকজন হানাদারকে হত্যা বা বোমা মেরে তাঁদের গাড়ি উড়িয়ে দিলে ভয়ে এই এলাকায় আসবে না তার। তাই পাক হানাদার বাহিনীর চলাচলের পথে ডিনামাইট বসাই। সেদিন, সোমবার বিকেল, পাক বাহিনীর গাড়ি যাওয়ার সময় ডিনামাইটটি বিস্ফোরণ হয়ে উড়ে যায়। ৪/৫ জন পাক সেনা ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আরও ১৪ জন আহত হয়।
মোজাম্মেল হক, গণকবর থেকে বেঁচে যাওয়া আবেদ আলীসহ এলাকাবাসী জানান, ওই ঘটনার পর ১৮ জুন শুক্রবার ওই গ্রামগুলো থেকে জুম্মার নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বাড়ি ফেরা মুসল্লি ও মাঠে কর্মকর্তাদের দেড়।দুই শ’ মানুষকে রাজাকার ও সেনারা ধরে এনে। শান্তি কমিটির আদেশ পালনকারী ও অন্যদের দু’টি সারিতে দাঁড়াতে আদেশ না বুঝেই গ্রামবাসীরা যে যার মত দুই সারিবদ্ধ হন। শান্তি কমিটির লোক হিসেবে এক সারির ছেড়ে দিয়ে অন্য সারির ৪০/৪৫ জন লোককে দুর্বিসহ নির্যাতন করে। প্রথমে তাঁদের স্তুপকৃত বিষাক্ত কাঁটাযুক্ত তৃণ (স্থানীয় ভাষায় ‘কাঁটা খুড়া’) উপর দিয়ে হাঁটায়। যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে তার পায়ে দড়ি বেঁধে পাশের একটি পরিত্যাক্ত বাড়িতে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়।
গণকবর থেকে বেঁচে যাওয়া চিরলা গ্রামের সলিম মিয়া জানান, তাকেসহ ৫/৭ জনকে গর্ত খুঁড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়। লম্বায় ৪/৫, প্রস্থে ১০/১২ এবং গভীরে ৪/৫ হাত গর্ত খোঁড়া হলে কাঁটা বিষে অজ্ঞান হয়ে পড়াদের জবাই করে ওই গর্তে ফেলে দেওয়া হয়। সলিম বলেন, “তাকেসহ গর্ত খোঁড়ার কাজে নিয়োজিতদের শেষের দিকে একই কায়দায় জবাই করে ওই গর্তে ফেলে দেওয়া হয়”। “এ সময় বৃষ্টি আসলে পাক সেনারা ক্যাম্পে চলে যায়। সন্ধ্যার পর অন্ধকার নেমে আসে। বৃষ্টির পানিতে জ্ঞান ফিরে এলে আহত অবস্থায় ৮ জন ওই গণকবর থেকে বেঁচে যান”।
অন্য এক বেসরকারি তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে, জয়পুরহাটের পাগলা দেওানে পাকবাহিনী ও তার দোসররা চার হাজার মানুষকে হয়তা, এক হাজার নারীর সম্ভ্রম হরণ এবং অসংখ্য বাড়িঘর ধ্বংস করে। পাগলা দেওয়ান ও তার আশেপাশের চর বরকত, নামুজানিধি, পুনন্দা, নওপাড়া, চিরলা, রূপনারায়নপুর, জগদীশপুর, ভুটিয়াপাড়া, মল্লিকপুরসহ অসংখ্য গ্রামে পাক নৃশংসতার চিহ্ন বর্তমান। মাজারের পঁচিশ হাত দূরে একটি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। এখানে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে পুঁতে রাখা হয়। মাজারের পশ্চিম দিকের বাঁধানো কূপটি মৃতদেহে ঠাসা ছিল। ভারতে যাওয়ার সময় শত শত বাঙালি পাকসেনাদের হাতে প্রাণ হারায়। আবার একসাথে ৭০/৮০ টি গরু ও মহিষের গাড়ি যাত্রী বোঝাই করে ভারতে যাওয়ার সময় পাকসেনাদের ধরে এনে সবাইকে গুলি করে হত্যা করে। প্রতিদিনই ওরা গ্রাম থেকে মেয়েদের ধরে আনতো এবং মাজারের চারপাশে নির্মিত বাঙ্কারে রেখে দিনের পর দিন ধর্ষণ করতো। স্বাধীনতার পর এর আশপাশ থেকে শাড়ি, ব্লাউজ ও অন্যান্য জিনিস পাওয়া গেছে। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম. এ. হাসান, পৃ.-৪২৪; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, দ্বিতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-৩৫২-৩৫৩; একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-১০২; দৈনিক সংবাদ, ১৬ এপ্রিল ১৯৯৪)
গণকবর থেকে বেঁচে যাওয়া চিরলা গ্রামের সলিম মিয়া বলেন, “এই পাগলা দেওয়ানেই গণকবরের পাশে প্রায় ১০০ গজের মধ্যে আরো একটি গণকবর রয়েছে। যুদ্ধ শুরু হলে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নাটোরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কয়েক হাজার হিন্দু ধর্মালম্বী নরনারী পাগলা দেওয়ান করিডোর হয়ে ভারতে যাবার সময় ব্রাশ ফায়ার করে তাঁদের হত্যা করে পাক হানাদাররা। খাস পাহনন্দা গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী এমদাদুল হক ও জয়পুরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সদস্য আফসার আলী জানান, সে সময় শরনার্থী হয়ে গরু গাড়িতে চড়ে ভারতে যাবার সময় প্রায় ২/৩শ’ হিন্দু নারীকে হানাদাররা ধরে গ্রামের পরিত্যাক্ত বাড়িতে রেখে পালাক্রমে রাতভর ধর্ষণ করত এবং সকাল হলে তাঁদের গুলি করে মেরে ফেলত। শিয়াল কুকুরে লাশ টানাটানি করত। ঐসব অর্ধগলিত লাশ, কঙ্কাল কুড়িয়ে জড়ো করে এই গণকবরে রাখা হয়েছে। পাগলা দেওয়ানের দুটি গণকবর সংরক্ষিত আছে।