গোবিন্দগঞ্জ কাটাখালি বধ্যভূমি
ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ করতোয়া নদীর কাটখালী সেতু ভাঙার মধ্য দিয়ে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ রংপুর থেকে পাকবাহিনীর সুসজ্জিত বহর সড়ক পথে গোবিন্দগঞ্জের দিকে আসছিল। এমন সংবাদে ২৬ মার্চ স্থানীয় ছাত্র-জনতা তা প্রতিহত করতে এক গোপন বৈঠক করে। পরের দিন সকালে পাক বাহিনীকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে মহাসড়কের এই সেতু ভেঙে ফেলার জন্য তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য জামালুর রহমান প্রধান ও থানা ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুল মতিন তালুকদারের নেতৃত্বে উজ্জীবিত ছাত্র-জনতা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সেতু ভাঙতে গিয়ে তা সম্ভব না হওয়ায় সেতুর উত্তর পাশে রাস্তা কেটে ও গাছ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
এ সময় রংপুর সেনানিবাস থেকে আসা পাক সেনারা নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই শহীদ হন উপজেলার তুলসী পাড়ার আবদুল মান্নান, মো. হারেজ, গোলাববাগের মনোরঞ্জন মহন্ত বাবলু, যিশুবাড়ী দরবস্ত গ্রামের আবদুল মজিদ, পুন তাইড় গ্রামের ফজলুল করিম, নীলকণ্ঠপুরের তোবারক আলী, পাটোয়া গ্রামের আবদুল কুদ্দুস, শাখাহার গ্রামের মোনোঢার হোসেন সরকার, সিরাজুল ইসলাম ও বুজরুক বোয়ালিয়ার বাবু দত্ত।
সেতু নির্মাণের সময় ঠিকাদাররা সেতুর উত্তর ও মহাসড়কের পশ্চিম পাশে তাঁদের বিশ্রামের ও শ্রমিকদের থাকার জন্য কয়েকটি ঘর তৈরি করে ছিলো। পরবর্তীতে ঐ জায়গাটি হাওয়াখানা নামে পরিচিত লাভ করে। এই হাওয়াখানায় ২৭ মার্চের প্রতিরোধ যুদ্ধের পর ঐ সেতু রক্ষার জন্য গাইবান্ধা শহরের আগেই এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সেখানে পাকসেনারা ক্যাম্প স্থাপন করে।
এরপর থেকে তারা ও তাঁদের দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সহায়তায় গোবিন্দগঞ্জ ও আশেপাশের এলাকায় চালায় ব্যাপক গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতন। মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত জেলা বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিকামী বাঙালিদের ধরে এনে এখানে হত্যা করতো। ঐ সেতুর উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম ধারে লাশ মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়। গোবিন্দগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার শ্যামলেন্দু মোহন রায় জানান, কুখ্যাত রাজাকার মোফাজ্জল হোসেন ও আতাউর রহমান বেলালের সহযোগিতায় প্রথমে তারা উপজেলার ফতেউল্যাপুরের রায় বাড়ি লুট ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। গোবিন্দগঞ্জ থানার দেড় সহস্রাধিক বাড়িঘর লুট করে ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পাঁচ শতাধিক মানুষ মানুষ হত্যা অসংখ্য নারীকে নির্যাতন করে তারা। এছাড়া ঐ সড়কে যে সব বাস চলাচল করতে পাক সেনারা সে বাস গুলো থামাতো। বাসের কোন নারী যাত্রিকে পছন্দ হলে তাঁদেরকে জোর পূর্বক নামিয়ে নিতো।
পাক বাহিনীর ওপর চালায় গেরিলা আক্রমণ শুরু হলে ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ে তারা। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনী তিন দিক থেকে ট্যাংক, কামানের ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ত্রিমুখী আক্রমণ চালায় পাকবাহিনীর কাটাখালী ক্যাম্পে। সারারাত ধরে চলে দু’পক্ষের গোলাবর্ষণ। এতে বহু পাকসেনা নিহত হয়, পালিয়ে আত্মরক্ষা করে অনেকে ও বহু সংখ্যক পাক সেনা আত্মসমর্পন করে। অবশেষে ১২ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় গোবিন্দগঞ্জ।