গাইবান্ধা সদর স্টেডিয়াম সংলগ্ন বধ্যভূমি
পাক হানাদার বাহিনীরা রংপুর থেকে এসে ’৭১ এর ১৭ এপ্রিল গাইবান্ধা স্টেডিয়ামে ঘাঁটি করে এবং তার কিছু দূরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউজে থাকতো পাক সেনা কর্মকর্তারা। শুরু করে তাঁদের পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ ও নারী নির্যাতন। প্রতি রাতেই অসংখ্য মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে স্টেডিয়াম সংলগ্ন দক্ষিণ পাশে কফিল সাহার গোডাউনে মাটি চাপা দিতো। বিভিন্ন বয়সী মেয়েদের ধর্ষণের পর ওখানে পুঁতে রাখা হতো।
পাক সেনারা গাইবান্ধায় আসার পর শহরের দোকান পাঠ, বাড়িঘরের দরজা-জানালা সব হয়ে যায় বন্ধ। শহরের প্রায় সব বাসিন্দারা গ্রাম গঞ্জে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এদিকে প্রথম দিনে বেশ কয়েকজন যুবক তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ হিন্দু ধরে এনে স্টেডিয়ামের পাশে রেল লাইনের ধারে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। পানি খেতে চাইলে মুমূর্ষ এ হতভাগ্যের মুখে প্রসাব করে দেয় পাক সেনারা।
প্রতিদিনই মহকুমার বিভিন্ন থানার গ্রামের বাড়ি-ঘর পোড়ানোর অভিযানে নামতো তারা। লোকজনকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে এসে গুলি করে হত্যা করে পুঁতে ফেলতো লাশগুলো। ইতোমধ্যে গঠন করা হলো মহকুমা শান্তি কমিটি। কমিটির আহবায়ক হলেন সাবেক মুসলিম লীগ নেতা খন্দকার আজিজুল ইসলাম। সদস্যরা হলেন মুসলিম লীগ ও জামাতপন্থি লোকজন। এবার সেই রাজাকাররা পালাতক আওয়ামী লীগ নেতা ও হিন্দু ব্যবসায়ীদের বাড়ীঘর ও দোকান লুট করে। আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় কারো কারো ঘরবাড়ি। রাজাকারদের কেউ কেউ নিজেদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে নিরীহ লোকজনদেরও পাক সেনাদের হাতে তুলে দেয়। পলাতক হিন্দু ব্যবসায়ীদের বাড়ি ও দোকান দখল করে নেয় রাজাকাররা। সে সময় পাক সেনাদের হাতে শহীদ হন – শহরের ব্যবসায়ী বিজয় কুমার রায়, পরেশ নাথ প্রসাদ, কেদার নাথ প্রসাদ, রামবাবু সাহা, জগত কর্মকার, ননী সাহা, মদন মহন দাস, উপেন্দ্র চন্দ্র দাস, যোগেশ চন্দ্র যায়, আনোয়ার হোসেনসহ নাম না আরও অনেকে। এ সংখ্যা হাজারেরও বেশি। রেললাইনের ধারেও গর্ত করে লাশ পুঁতে রাখা হত। এছাড়াও বিভিন্ন বধ্যভূমিতে লাশ পুঁতে রাখতো। অনেক খহেত্রে যাঁদেরকে হত্যা করা হতো তাদেরকে দিয়েই সেই গর্ত খুঁড়িয়ে নেওয়া হতো।
৮ ডিসেম্বর সকালে ভারতীয় বিমান বাহিনীর দু’টি বিমান গাইবান্ধা রেল স্টেশনের পাশে বোমা ফেলে। পরদিন ৯ ডিসেম্বর তিন ট্যাংকসহ কর্ণেল দত্তের নেতৃত্বে ভারতীয় যৌথবাহিনী সাদুল্লাপুর থেকে দুপুরে গাইবান্ধা রওনা হয়। তবে ওই দিন সকালেই কোম্পানি কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব এলাহি রঞ্জুর নেতৃত্বে দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা গাইবান্ধা শহরে প্রবেশ করে। আগে আচ করতে পেরে সকাল ১০টার মধ্যেই গাইবান্ধা স্টেডিয়াম ও পানি উন্নয়ন বোর্ডে রেস্ট হাউস অবস্থান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে পাক সেনারা বগুড়ার দিকে পালিয়ে যাবার পর স্টেডিয়ামের ক্যাম্পে মেয়েদের অসংখ্য পরিধেয় বস্ত্র পাওয়া যায়। (তথ্যসূত্র: ১. গাইবান্ধার ইতিহাস ও ঐতিহ্য: গাইবান্ধা ফাউন্ডেশন; একাত্তরে গাইবান্ধা: ড. মো. মাহবুবর রহমান, ‘আমার উপলব্ধিতে মুক্তিযুদ্ধে গাইবান্ধা’ মুহম্মদ আজিজুল হক ও জেলা বধ্যভূমি সংরক্ষন কমিটির আহবায়ক জি. এম. মিঠুর সাক্ষাৎকার।)