বড়ইতলা গণহত্যা
“দাড়াও পথিক বর, জন্ম যদি তব এ বঙ্গে, তিষ্ট ক্ষনকাল এ সমাধিস্থলে” বড়াইতলা গণহত্যা শহীদদের স্মরনে নির্মিত স্মৃতিসৌধের ফলকে স্থাপন করা মাইকেল মধুসূদন দত্তের বিখ্যাত কবিতার এ লাইন দু’টি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ পথিকদের। ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর কিশোরগঞ্জের বড়ইতলা গ্রামে পাকবাহিনী নৃশংস গণহত্যা করে। একই সঙ্গে ৩৬৫ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে এবং তাদের হাতে আরও দেড় শতাধিক মানুষ আহত হয়। সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া লোকজন গণহত্যার ভয়াবহ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আজও আতংকে শিউরে উঠেন।
প্রত্যক্ষ্যদর্শী ও অন্যান্য সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর বুধবার সকালে একদল পাকসেনা ট্রেনে কিশোরগঞ্জ সদরের (তৎকালীন মহকুমা) নিকটবর্তী কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের বড়ইতলা গ্রামে আসে। এ সময় তাড়া গ্রামবাসীকে পাকিস্তানের পক্ষে উদ্বুদ্ধ করতে কর্মসূচি পালন করে। কিন্তু বড়ইতলা গ্রামে প্রবেশের পর পথ হারিয়ে ফেলায় একজন পাকসেনা দলছুট হয়ে পড়ে। কথিত আছে, উদ্বুদ্ধ করণ কর্মসূচী চলাকালে তাদের একজন সেনা কম থকার বিষয়টি পাক সেনা কর্মকর্তাদের নজরে আসে। এ সুযোগে স্থানীয় রাজাকাররা গুজব রটায় যে পাকসেনাকে গুম করেচে গ্রামবাসী। এরপর পাকবাহিনী উন্মত্ত পশুর হিংস্রতা নিয়ে গ্রামবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকসেনা ও তাদের দোসররা বড়ইতলা, চিকনিরচর, দাম্পাড়া, কালিকাবাড়ি, কড়িয়াইল, তিলকনাথপুর, গোবিন্দপুর ও ভূবিরচর গ্রামের পাচ শতাধিক লোককে জোর পূর্বক ধরে এনে কিশোরগঞ্জ–ভৈরব রেল লাইনের পাশে বড়ইতলা গ্রামের একটি স্থানে জড়ো করে। গ্রামবাসীদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে পাকসেনারা বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে, রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে ও গুলি করে শুরু করে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। বর্বর এ হত্যাযজ্ঞে ৩৬৫ জন নিহত হয়। আহত হয় দেড় শতাধিক ব্যাক্তি, যাদের অনেকেই গণহত্যা থেকে বেঁচে গেছেন।
চিকনিরচর গ্রামের ফিরোজ উদ্দিন বলেন, “সংগ্রামের সময় পাকবাহিনী বড়ইতলায় সাড়ে ৩শ’ লোক হত্যা করে। আমাদের এলাকা থেকে ৩৫ জন এবং আমাদের পরিবারে আমার বাবসহ ৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে”। মোঃ ইসহাক ভূঁইয়া তার বাবা, চাচা, চাচাত ভাইসহ তার ২২জন আত্মীয় শহীদ হওয়ার কথা জানান।
আহত হয়েও বেঁচে যাওয়া চিকনিরচর গ্রামের মন্তাজ উদ্দিন বলেন, “হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে একজন পাকসেনা আমাকে বেয়োনেট দিয়ে মাথায় আঘাত করলে গুরুত্বর আহত হয়ে অচেতন হয়ে মাটিতে লাশের স্তূপের উপর পড়ে যাই। পুরো একদিন আমি লাশের স্তূপের মধ্যে পড়েছিলাম। পরদিন একজন মহিলা আমাকে লাশের স্তূপ থেকে উদ্ধার করে”।
দাম্পাড়া গ্রামের আলী আকবর বলেন, “১৯৭১ সনের ১৩ অক্টোবর এখানে পাকবাহিনী কয়েক হাজার লোক জড়ো করে। এর মধ্যে আমিসহ আমার বাড়ির কয়েকজন লোকও জড়ো হই। এরপর পাকবাহিনী গুলি করে ও বেয়োনেট দিয়ে মানুষ হত্যা করে। আমার আপন চাচা, চাচাতো ভাই, ভাতিজাসহ ৮ জন মারা যায়। আমি লাশের স্তূপের নিচে পড়ে গিয়ে রক্ষা পাই। পাকবাহিনী যাবার পর বের হয়ে আসি। দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত মরা লাশের নিচে ছিলাম”।
চিকনিরচর গ্রামের জিল্লুর রহমান বলেন, “অনেক লোকজন একসঙ্গে জড়ো করে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি ছুঁড়ে লোক মারা শুরু করে। আমি লাশের স্তূপের নিচে পড়ে রক্ষা পাই। পাকবাহিনী যাওয়ার পর লোকজন আমাকে বের করে আনে”।
দামপাড়া গ্রামের বাসিন্দা স্থানীয় শিক্ষক আজিজুল হক, বৃদ্ধা সখিনা বেগম, কালিকাবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা মোঃ রুকন উদ্দিন এদিনের বর্ণনা দেন। ২০০০ সালে জেলা পরিষদের উদ্যোগে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়।