You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার আকাশে বাতাসে মুক্তিবাহিনীর জয়ধ্বনি

বিজয় বার্তা। ঢাকা-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম ও গত ২রা অক্টোবর-চম্পলনগরের সন্নিকটে মুক্তিবাহিনীর মারমুখী সংগ্রামে ২ জন পাক সেনা খতম হয়। এই অঞ্চলে অপর এক আক্রমণে পাঁচজন পাক হানাদার বাহিনী নিহত হয়। | চলতি মাসের প্রথম দিকে পাক বাহিনীর সৈন্য বােঝাই একটি জীপ কুমিল্লায় মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যায় এই গাড়ির যাত্রী একজন পাক অফিসারসহ বেশ কয়েকজন পাক সৈন্য নিহত হয়। খুলনা-যশাের-কুষ্টিয়া ও মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা মাদনা অঞ্চলে চারজন হানাদার বাহিনীকে খতম করে এবং অপর দুজনকে আহত করে। মুক্তিবাহিনীর অপর এক গ্রেনেড আক্রমণে দত্তসনগরের হানাদার বাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবং একজন হানাদার নিহত হয়।  ৩রা অক্টোবর গয়েশপুর অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণ পাঁচজন পাক হানাদার সৈন্য নিহত এবং চারজন গুরুতরভাবে আহত হয়। ঐদিনই চাঁদপুর অঞ্চলে সাতজন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণে ভীত সশস্ত্র হয়ে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। অপর এক সংবাদ প্রকাশ, মাদরা অঞ্চলে ২রা অক্টোবর মুক্তি বাহিনীর দুঃসাহসিক সৈনিকদের প্রবল আক্রমণে ছয়জন পাক সেনা খতম হয়। গত ৫ অক্টোবর বেরিলবাড়ীর ৩৫ জন পাক হানাদার খতম হয় এবং চারজন গুরুতরূপে আহত হয়। ঐ দিনই মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতায় বকশী ও বেলিয়াডাঙ্গার মধ্যেকার টেলিফোন যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়। বেকারির সন্নিকটে পাক বাহিনীর একটি জীপ মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়। মেজর এম, এ, জলিলের নির্দেশ রাজাকার বাহিনীতে ও দালাল বাহিনীতে যারা আছ, অস্ত্রশস্ত্র সহ অতি সত্বর আমার কাছে আত্মসমর্পণ  যে সব দুস্কৃতকারী মুক্তিফৌজের নামে চাঁদা আদায় করছাে, লুঠতরাজ করছে, নারী-ধর্ষণ করছে। তাদেরকে হুসিয়ার করে দিচ্ছি, আমাকে তােমরা ভাল করেই জানাে, পিরােজপুরে ডাকাতির দায়ে যেমনভাবে ডাকাতের বুকে গুলি চালিয়েছি, তেমনভাবে তােমাদের বুকেও চালাবাে। 

তােমরা মনে করেছিলে মুক্তিফৌজ এখানে আসবে না, আমি কোনদিন আসবাে না; কিন্তু দেখাে আমরা বাঙ্গালির দুঃখমােচন করতে বঙ্গবন্ধুর নামে অগ্নি-শপথ নিয়ে তােমাদের এখানে এসেছি।  মুক্তিবাহিনী যে যেখানে আছাে যােগাযােগ কর, হানাদার কুত্তাদের নিধন করতে তােমাদের জন্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছি।  যে বেইমানি বাঙালীর সাথে বেইমানী করেছে বা করবে তারা মৃত্যুর জন্য তৈরি হয়ে যাও, আমার বুলেটে আগুন বেশি, আমার বুলেট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। তােমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণও আমার সাথে যােদ্ধার বেশে ফিরে এসেছেন। তাঁদেরকেও তােমরা দেখতে পাবে রণক্ষেত্রে, আমার সাথে। বঙ্গবন্ধুর অগ্নি-মন্ত্রে আমি মনে করি, খাঁটি বাঙালীরূপে তােমাদের মাঝে পঁড়িয়েছি, তাই আমি চাই তােমরাও আমার মতাে বাঙালী রূপে বাংলায় থাকবে। থাকবে সােনার বাংলায় সােনার বাঙালী রূপে বেইমান হয়ে নয়, দালাল হয়ে নয়  বরিশাল। গত সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনী উজিরপুর থানা আক্রমণ করে ৭ জন রাজাকার, ২ জন পাক সেনা এবং ২ জন পুলিশকে হত্যা করে এবং উক্ত স্থান থেকে কিছু রাইফেল উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। মুক্তিবাহিনী পুনরায় উক্ত থানা আক্রমণ করে ১৭ জন রাজাকার, ৪ জন পাকসেনা, ৩ জন মিলিশিয়া ও ২ জন পুলিশকে হত্যা করে। পরে উক্ত এলাকার বেশ কিছুসংখ্যক রাজাকার রাইফেলসহ মুক্তি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। উক্ত থানার প্রায় স্থানেই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখা যায় । | মুক্তিবাহিনী মুলাদী থানা আক্রমণ করে ১৯ জন পাক সেনা খতম করে এবং ৪টি চায়না রাইফেলসহ মােট ১৩টি রাইফেল উদ্ধার করে। এই খণ্ড যুদ্ধে বাকি পাক সেনারা উক্তস্থান থেকে ভয়ে পালিয়ে যায়। 

আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা বারিপাড়া থানা আক্রমণ চালিয়ে ৮৬ জন রাজাকার, একজন নায়কসহ ১৭ জন পাঞ্জাবী সেনা, ১৩ জন মিলিশিয়া ও ৬ জন পুলিশকে হত্যা করে। এছাড়া সামরিক বাহিনীর একখানা লঞ্চ ধ্বংস করে দেয় এবং একখানা লঞ্চ দখল করতে সমর্থ হয়। খুলনা । পাক বাহিনী একখানা গানবােট এবং পাঁচখানা লঞ্চ বােঝাই সৈন্যসহ শ্যামনগর থানায় কৈখালী নামক স্থানে গমন করলে মুক্তিযােদ্ধারা পাল্টা আক্রমন চালায় ফলে পাক হানাদার বাহিনীর লঞ্চসমূহের প্রচুর ক্ষতি হয়। ফলে শত্রুসৈন্য ওখান থেকে পালিয়ে যায় । একদল মুক্তিযােদ্ধা গত ২৬ সেপ্টেম্বর বসন্তপুরের পাক ঘাঁটিতে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলতে। সক্ষম হয়েছেন। গত ২৯ সেপ্টেম্বরে কালিগঞ্জের পিরােজপুরে এক সম্মুখ যুদ্ধে ২০ পাকসেনা ও ৪০ জন রাজাকার খতম হয়েছে। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র মুক্তি বাহিনীর হস্তগত হয়েছে। এখানের যুদ্ধে একজন মুক্তিযােদ্ধা আহত হয়েছেন। এছাড়া ২৮শে সেপ্টেম্বর এখানে আর এক সম্মুখ যুদ্ধে প্রায় ৮০ জন পাক সেনা খতম হয়েছে। রংপুর-দিনাজপুর-রাজশাহী ও বৈদ্যনাথপুর অঞ্চলে দুর্দমনীয় মুক্তিযােদ্ধাদের এক প্রবল আক্রমণে পাক বাহিনীর দশজন হানাদার সহ একজন পাক অফিসার নিহত হয়। এ ছাড়া পর পর নয়াদীঘি, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর প্রভৃতি অঞ্চল গেরিলাবাহিনীর অসম সাহসী আক্রমণে ত্রিশজন শত্রুসৈন্য নিহত এবং সড়ক ও টেলিফোন যােগাযােগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। 

৪ঠা অক্টোবর ভুতমারি অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর মাইন বিস্ফোরণে একটি পাক জীপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জীপের সব কজন সৈনিকই নিহত হয়। ঐ দিনই চিরিয়া বন্দর অঞ্চলে অপর এক সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর যােদ্ধাদের আক্রমণে দশজন শত্রু সৈন্য নিহত এবং কয়েকটি রাইফেল হস্তগত হয়। জীবনকে দিয়েছে ওরা বিলিয়ে (স্টাফ রিপাের্টার) সম্প্রতি বাংলাদেশ ভ্রমণ করতে গিয়ে জানা গেছে বাংলাদেশের কয়েক হাজার লাঞ্চিতা যুবতীকে পাক সৈন্যরা মুক্তি দিয়েছে। বিগত ২৫শে মার্চের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশের নগর-বন্দর-গ্রাম থেকে ইয়াহিয়ার গুণ্ডা সৈন্যরা এই সমস্ত যুবতীদের জোর করে ধরে নিয়ে সৈন্য ছাউনিতে আটকে রেখেছিল। এই কয়েক হাজার সদ্য মুক্ত মেয়েরা পাক সৈন্য ছাউনি থেকে মুক্ত হয়ে জীবনের সবকিছু হারিয়েও আবার নতুন করে বাঁচবার আশায় তাদের বাবা-মার কাছে ফিরে গিয়েও দেখা করতে পারেনি। কারণ এদের অনেকেরই বাবা-মা হয় পাক সেনাদের হাতে মৃত্যুবরণ করেছে নয়তাে দেশ ত্যাগ করে ভারতে। আশ্রয় নিয়েছে। | শেষ আশ্রয়টুকু হারিয়ে আজ এই সব যুবতীরা পথে পথে মৃত্যুর মুখােমুখি দাঁড়িয়েছে। তবে মৃত্যুর আগে এরা শপথ নিয়েছে প্রতিহিংসার। যারা তাদের সুন্দর জীবনকে অপবিত্র করেছে তাদের শেষ করে তবে এরা পৃথিবী থেকে মুক্তি নেবে বলে জানা গেছে। | বাংলাদেশের প্রতিটি শহরে এরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। জানা গেছে যখন খানসেনারা রাস্তায় টহল। দিতে নামে তখন এই সব যুবতীরা আক্রমণ চালিয়ে অনেক খানসেনাকে খতম করে মৃত্যুবরণ করেছে। এদের কাছে অস্ত্র বলতে দেশী অস্ত্র থাকে।

বিপ্লবী বাংলাদেশ । ১: ৮

১০ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!