You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.10 | গেরিলাযুদ্ধ না প্রত্যক্ষ যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক

গেরিলাযুদ্ধ না প্রত্যক্ষ যুদ্ধ

অধ্যাপক সামাদ বাংলাদেশ সরকারের সেনাবাহিনীর সমরাধিনায়ক এ, জি, ওসমানী ঘােষণা করেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এখন দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে পৌছেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে চলেছিল গেরিলা যুদ্ধ, এখন আরম্ভ হবে শত্রুর সঙ্গে মুখামুখি প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। গেরিলা যুদ্ধ আর প্রত্যক্ষ সম্মুখ যুদ্ধের লক্ষ্য থাকে আলাদা। গেরিলা যুদ্ধের উদ্দেশ্য হল প্রধানত আচমকা আক্রমণ করে শত্রুকে সংখ্যার কমিয়ে আনা, তার সরবরাহ ব্যবস্থাকে বানচাল করে লজিসটিকস-এর সমস্যা সৃষ্টি করা। গেরিলা যুদ্ধ একটা দেশের স্বাধীনতা আনবার পক্ষে বিরাট সহায়ক কিন্তু তা বলে গেরিলা যুদ্ধ একটা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জয় পরাজয় চূড়ান্ত ভাবে নিষ্পত্তি করে না। গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুকে দুর্বল করে আনবার পর প্রযােজন হয় শত্রুর উপর সরাসরি আঘাত হেনে চুড়ান্ত বিজয় লাভের। গেরিলা যুদ্ধের শেষে তাই প্রয়ােজন হয় প্রত্যক্ষ সম্মুখ সমরের। সম্মুখ সমরকে বাদ দিয়ে অন্তিম বিজয় সম্ভব নয়। পাক বাহিনী গত ছয় মাসের গেরিলা আক্রমণের ফলে অনেক দুর্বল। হয়ে পড়েছে। এখন প্রত্যক্ষ আক্রমণ করে তাকে উত্থাৎ করবার সময় এসেছে। এই কয়মাসে পাক বাহিনীর মনবল যে নিম্নমানে নেমে এসেছে, তাতে পাক বাহিনীর উপর প্রত্যক্ষ আঘাত হানতে আরম্ভ করবার পথে কোন বাধা নেই। গেরিলা যুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য শত্রু সৈন্যের মনবল ভঙ্গ করা। এই অতিষ্ঠ এখন বহুলভাবে অর্জিত হয়েছে। এছাড়া এখন এমন কতগুলি কথা ভাববার সময় এসেছে, যেগুলি দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

একটা দেশে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হলে তার জন্য প্রয়ােজন-একটা খুবই সুসংগঠিত দল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ছিল একটি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী গণ প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের চরিত্র ছিল বিপ্লবী প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা। আওয়ামী লীগের গেরিলা যুদ্ধ চালাবার মত সাংগঠনিক প্রস্তুতি ছিলনা। কিন্তু তবুও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এখন পর্যন্ত গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে, কারণ। জনসাধারণের মধ্যে ছিল উগ্রদেশ প্রেম ও আত্ম-নিয়ন্ত্রণ বাসনা। সারা দেশের মানুষ চেয়েছিল, অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হােক। তাই মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে এগিয়ে এসেছিল আপনা হতে তারা আওয়ামী লীগের পাশে। কারণ আওয়ামীলীগই ছিল একমাত্র দল, যার লক্ষ্য ছিল জাতীয় আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার, গণতন্ত্র ও মানুষের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সহায়ক বিধিবিধান রচনার জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা। আওয়ামীলীগ ভেবেছিল জনগণের কল্পনা ও আকাঙ্ক্ষাকে উদ্দিপিত করতে। তাদের নতুন আশায় এক বিরাট গণআন্দোলনে টেনে আনতে। কিন্তু বর্তমানে কতগুলি অসুভ লক্ষণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সে সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রয়ােজন।  যে সব দল শেখ সাহেবের আদর্শে বিশ্বাস করতােনা যারা-মনে করত বাঙালীর আত্ম নিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাৰী মূল্যহীন, যারা মনে করত গণতন্ত্রের কথা বলার অর্থ জনসাধারণকে প্রতারণা করা, তারা আজ অনেকেই রাতারাতি শেখ ভক্ত হয়ে উঠেছে। তারা যাচ্ছে গেরিলা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে। 

সমস্ত স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব তাদের হাতে নিয়ে আসতে। বাঙলাদেশের বাইরের নানা গণতন্ত্রে অবিশ্বাসী বিপ্লবী’ দল উপদেশ সরবরাহ করছে এদের। যেমন কোন বামপন্থী দলের পুস্তিকার বাঙলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের বিশ্লেষণ দিতে যেয়ে বলা হয়েছে বিপ্লবী শক্তিকে একটা কথা এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে। তা হচ্ছে, তারা যদি এই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব গ্রহণ করতে চান তাহলে শুধু মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে সমালােচনা করে এই নেতৃত্ব তারা গ্রহণ করতে পারবেন না। কারণ, বিপ্লবী নেতৃত্ব কড়াকাড়ি করে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এই নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবার একটিই রাস্তা আছে। বর্তমান। স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে যে ন্যাশনাল লিবাশেন ফ্রন্ট গঠিত হবে, সেই ন্যাশনাল লিবারেশান ফ্রন্টের ঐক্যকে রক্ষা করে যদি তার ভিতরে আদর্শগত সংগ্রাম তারা যথাযথ ভাবে পরিচালিত করতে পারেন, আর যে সশস্ত্র লড়াই দীর্ঘ দিন ধরে হয়ত সেখানে। (বাঙলাদেশে) চলবে সেই লড়াইয়ে যদি যােগ্যতম রাজনৈতিক, সাংগঠনিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবার যােগ্যতা তাদের থাকে, তা হলে এই ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত তাঁদের হাতে চলে যাবে।’ এই বইতে কি ভাবে এটা সম্ভব হতে পারে তার আরাে আভাস দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে, ‘মুক্তি যুদ্ধ যদি দীর্ঘ স্থায়ী হয়, সশস্ত্র সংগ্রামের পথে পরিচালিত হয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে স্বাধীনতা আন্দোলনে মডারেট পন্থি নেতৃত্ব হটে গিয়ে বিপ্লবী নেতৃত্বের অ্যুত্থান ঘটবে এবং তা শেষপর্যন্ত চীনের প্রভাবে চলে যাবে। চীনের প্রভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব চলে গেলে তাতে বাংলাদেশের মানুষের কি কল্যাণ। হবে তা অবশ্য পুস্তিকাটিতে বলে দেওয়া হয়নি। পুস্তিকাটিতে একদিকে যেমন বাংলাদেশের হয়েছে। তেমনি আবার গাওয়া হয়েছে বাংলাদেশ সম্পর্কে চীনের নীতির সাফাই। আমরা অনেকের মুখে শুনতে পাচ্ছি যুদ্ধ দীর্ঘ হবে। এঁরা যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী করতে চান আওয়ামীলীগের হাত থেকে ক্ষমতা তাদের হাতে নিয়ে আসতে পারবার কথা চিন্তা করে। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্বাসী নয়, এমন নানা দলের লােক বলে বেড়াচ্ছেন এই সব কথা।

এদের লক্ষ্য দেশ বাসীর স্বাধীনতা নয়, দেশের ক্ষমতা দখল। এরা একবার ক্ষমতার আসলে দেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সম্ভাবনা বহুদিনের জন্য বিলুপ্ত হবে। আগে এরা ছিলেন শেখ বন্ধু। কারণ ঐ বেশেই জনগণকে প্রতারণা করা সহজ। বাঙলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যত সংক্ষিপ্ত হয়, বাঙালীর পক্ষে ততই মঙ্গল। আমরা বাঙলাদেশকে একটি ভিয়েতনামে পরিণত হতে দেখতে চাই না। দেখতে চাইনা অপ্রয়ােজনে আমাদের লক্ষ লক্ষ দেশবাসীর মৃত্যু! আমরা চাইনা রােমান্টিক বিপ্লবের বেদিমূলে উৎসর্গীকৃত হােক আমাদের দেশের শতশত তরুণ প্রাণ । আমরা চাইনা বিকলাঙ্গ বাঙালীর সংখ্যা অহেতুক বৃদ্ধি ঘটাতে। আমাদের কাছে স্বাধীনতা যেমন কাম্য তেমনি ভালবাসার বস্তু হল শত শত মানুষের জীবন। মানুষকে বাদ দিয়ে, তার সুখ দুঃখ অনুভূতিকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতা আন্দেলনকে সার্থক করা কোন বিপ্লববাদের মিছিলে আমরা ছুটতে পারি না। সেই সরু মরিচিকা ধ্বংস করাবে বাঙালী জাতিকে। তাই গেরিলা যুদ্ধ না চালিয়ে সম্মুখ সমরে নেমে পাক বাহিনীকে যত শীঘ্র সম্ভব উৎখাত করবার চেষ্টা করাই শ্রেয়। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ খুবই জনবহুল দেশ। সারা মানব জাতির শতকরা দুই ভাগ লােক হল। বাংলাদেশের বাঙালী। তাই এখানে দীর্ঘ যুদ্ধ চলার অর্থ হল বহু লক্ষ লােকের প্রাণ নাশ। নিদারুণ দুঃখ যন্ত্রণা। আমরা আমাদের দেশকে ভালবাসী। ভালবাসী দেশের মানুষকে। তাদের কথা চিন্তা করেই নির্ধারণ করতে হবে আমাদের যুদ্ধনীতি। কোন হৃদয়হীন ইউটোপিয়ান বিপ্লব বাদের গােড়ামীর উপর নির্ভর করে আমরা আমাদের দেশের ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রিত হতে দিতে পারি না।

দাবানল ১৫৩

১০ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯