You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.10 | মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের আলেখ্য পঁচিশে মার্চ থেকে পঁচিশে সেপ্টেম্বর - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের আলেখ্য পঁচিশে মার্চ থেকে পঁচিশে সেপ্টেম্বর

(নিজস্ব নিবন্ধকার) গত ২৫ শে সেপ্টেম্বর আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ছমাস পূর্ণ হল। ২৫ মার্চ বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কময় দিন হিসাবে ইতিহাসের ছাত্রদের শুধু ত্রাসের সঞ্চার করবে না-এই দিনটি পৃথিবীর শেষ দিন  পর্যন্ত মানবতার অস্তিত্বে তার পরাজয়ের রক্তাক্ত স্বাক্ষর হিসাবে বিবেকে মারাত্মক দংশন করে যাবে। ২৫ মার্চ রাতে সুপরিকল্পিতভাবে অসহায়, ঘুমন্ত জনগণের উপর আক্রমণ চালায় ইয়াহিয়ার জিঘাংসু ঘাতকেরা। পূর্ণ যুদ্ধের জন্য তৈরি ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী বেলুচিস্তানের বােমারু বিমানের বিকৃত বৈমানিক টিকাখানের নির্দেশে যন্ত্রের মত ধ্বংসলীলা শুরু করে। এই হানাদার বাহিনী প্রথমেই বাংলাদেশের প্রতিরােধ ব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্যে ই, পি, ও আর পুলিশ বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে তাদের খতম করার চেষ্টা করে। ঢাকার পিলখানা রাজার বাগ পুলিশ লাইন তাদের মর্টার ও ট্যাঙ্কের গােলা বর্ষণে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। একই সাথে তারা বাংলার দ্বিতীয় এবং প্রধান প্রতিরােধ সাংস্কৃতিক ফ্রন্টকে চিরতরে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস রােকেয়া হল, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কোয়াটার গুলিতে যথেচ্ছভাবে মেশিনগান ও মর্টার আক্রমণ চালায়। আজ ডক্টর গােবিন্দ দেব নেই, ডক্টর গুহঠাকুরতা নেই। নিরুদ্দিষ্টের তালিকা দিয়ে শেষ করা যাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের মধুদা ও তার পরিবার বর্গকেও তারা মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করেছে।

৪৮ ঘণ্টার যুদ্ধে একটা জাতিকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে হলে যা যা করণীয় তার কোন কিছুই ইয়াহিয়ার ভাড়াটে সৈন্যরা বাদ দেয় নি। নিরাপরাধ জনগণের অপরাধ কি? অপরাধ তারা স্বাধীনতা চেয়েছিল এবং সেই অপরাধেই আজ প্রায় এককোটি বাঙালি শরণার্থী হিসাবে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। স্বাধীনতা চেয়ে আমরা ভুল করেছিলাম।  স্বাধীনতা আদায় করতে হয়। মুখের কথায়, জোরালাে বক্তৃতায়, পত্রিকার প্রবন্ধে স্বাধীনতা লাভ হয় না। স্বাধীনতার জন্যে দরকার সংগ্রামের-আত্মদানের। ২০ মার্চ রাতেই আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। মুক্তি সংগ্রামের এই ছমাস পূর্তি উপলক্ষে ভাষণ দিতে গিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশ সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা ক্ষান্ত হব না। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ গত ১৬ সেপ্টেম্বর মুজিব নগরে বলেন যে, ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশে একনায়কত্ব ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ঐ দিন পাকিস্তানের জঙ্গী ডিক্টেটর আয়ুব খানের শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার সময় বহু ছাত্র-যুবক ঢাকার রাস্তার পুলিশের গুলিতে নিহত হন। বস্তুত ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর নয় তারও আগে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখেই মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমেদ বলেছেন, আমাদের। লক্ষ্য হচ্ছে পূর্ণ স্বাধীনতা। আমরা কোন সমাধান বা মীসাংসাতে রাজি নই।

বাংলাদেশের জনগণের একান্ত ইচ্ছার কথাই তাঁদের বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে। এ ছমাসে বিশ্ববাসী উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে মুক্তিকামী মানুষকে পৃথিবীর কোন শক্তি দমিয়ে রাখতে পারে না। এ দু’মাসে ইয়াহিয়া-টিক্কা-ভট্রো চক্র বুঝতে পেরেছে, তারাই পাকিস্তানের সব চেয়ে বড় শত্রু-পাকিস্তানকে তারা সমাধিস্থ করেছে এবং বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। এ দু’মাসে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের লাভ লােকসানের পরিমাণ যাচাই করে দেখার একটা বিরাট সুযােগ এসেছে। যুদ্ধে জয় অথবা পরাজয় অবধারিত। এ দু’মাসে আমাদের সাফল্যের উদাহরণ দিয়ে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্ণেল এ, জি, উসমানি জানিয়েছেন যে, মুক্তিবাহিনী এ পর্যন্ত হানাদার বাহিনীর ২০ হাজার সৈন্য ও তিনশ অফিসার খতম করেছেন। তুলনামূলকভাবে আমাদের পক্ষে হতাহতের পরিমাণ খুবই সামান্য। প্রতি ৪০ জন শক্রর জন্য আমাদের একজন বীর সেনানী শহীদ হয়েছেন। 

আমাদের মুক্তিবাহিনীর দখলে এখন, বাংলাদেশের এক বিরাট মুক্তাঞ্চল রয়েছে। এখানে ভুল করার একটা অবকাশ থাকে। মুক্তিযােদ্ধারা গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করেন। তারা শত্রু সৈন্যের উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে তাদের ঘায়েল করে ছায়ার মত মিলিয়ে যান। তারা ব্যাপক আকারে পাকিস্তানী হানাদারদের হামলার খবর পেলেই মুক্তাঞ্চল ছেড়ে সুবিধামত পশ্চাদপসরণ করে নিরাপদ স্থানে খাঁটি তৈরি করেন। তার মানে এই নয় যে তারা পরাজিত হয়ে পশ্চাদপসরণ করেন- এযুদ্ধের রীতিই এটা।

কুমিল্লা ও সিলেট অঞ্চলে এখন এক বিরাট মুক্তাঞ্চল রয়েছে এবং সেখানে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন প্রবর্তিত হয়েছে। খুব সংক্ষিপ্তভাবে আমাদের সামরিক সাফল্যের একটা হিসাব পাওয়া গেল। রাজনৈতিক দিক থেকে আমাদের সাফল্য তুলনাহীন। সমসাময়িক কালে এ জাতীয় ঘটনার নজীর বহু রয়েছে। মধ্য প্রাচ্য, দূর প্রাচ্য এজাতীয় সমস্যায় জর্জরিত। ভিয়েনাম, কাম্বােডিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, লাতিন আমেরিকা এবং আজিকার বহুদেশ এই ব্যাধিতে বছরের পর বছর ধরে ভুগছে। কিংবা বাংলাদেশের ব্যাপক গণহত্যার বিংশ শতাব্দীর মানুষ নাদির, চেঙ্গিস, হিটলারের নৃশংসতার দিকে ফিরে চেয়েছেন-মানবতার এবং বাংলাদেশের জনগণের এটাই সবচেয়ে বড় লাভ। এই জঘন্য গণহত্যার প্রতিবাদে বিশ্বের খুব কম দেশই চুপ করে থেকেছেন।

ইয়াহিয়ার গােয়েবেলসীয় প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে আরব রাষ্ট্রবর্গ প্রথমে একটি ইসলাম রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চান নি। অবশ্য আমাদের মতই মুক্তিযুদ্ধে রত আলফাতাহ ও অন্যান্য মুক্তি সংগ্রামী দল আমাদের প্রতি আগেই সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ মুসলীন রাষ্ট্রে একনায়কত্ন ও মধ্যযুগীয় প্রশাসন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। নিজের দলের সদস্যকে সমর্থন জানানাের জন্যেও এই রাষ্ট্র প্রধানগণ প্রথমদিকে পাকিস্তানের মন রেখে কথা বলেছে। কি প্রতি তাদের মােহ ভঙ্গ হয়েছে। তারা বিশ্ববিবেকের প্রতিবাদে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছেন। তারা এটাও বুঝেছেন একটা অস্তিতবিহীন দেশকে সমর্থন জানিয়ে লাভ নেই কারণ পাকিস্তান এখন মৃত। সম্প্রতি মিশরের প্রভাবশালী সরকারি পত্রিকা আল আহরামের সিনিয়র এডিটর জনাব ক্লোভিস মাকসুদের বাংলাদেশ সম্পর্কে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে আরব জগতের মতামত ব্যক্ত হয়েছে। তিনি বলেছেন বাংলাদেশ এখন বাস্তব সত্য। এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। বিশ্বের জনসাধারণই শুধু বাংলাদেশের মর্মান্তিক ঘটনাবলীতে প্রতিবাদে সােচ্চার হয়ে ওঠেন নি- তারা বাংলাদেশের মুক্তি সম্রামের ন্যায্যতাও উপলব্ধি করতে পেরেছেন। আলােড়িত হয়ে উঠেছে জাতিসংঘ।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৬তম অধিবেশনে বাংলাদেশের সমস্যরা পৃথিবীর মানুষকে তাদের বক্তব্য পেশ করেছেন। পাকিস্তানের দালালরা বহু বাধা বিঘ্ন সৃষ্টি করার চেষ্টা করে শােচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সেখানে জাতিসংঘের প্রেসিডেন্ট উথান্ট প্রথমে বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ঘটনা বলে অভিহিত করেছিলেন। বৃটিশ সরকারেরও অনুরূপ মত ছিল। কিংবা ঘটনার ব্যপকত্ব এবং জাগ্রত বিশ্ব জনমতের কাছে তারা হার স্বীকার করেছেন। জাতিসংঘ প্রেসিডেন্ট প্রিন্স সদরুদ্দীনকে পাঠিয়ে ছিলেন শরণার্থীদের অবস্থা পরিদর্শনের অজুহাতে বাংলাদেশে জাতিসংঘ বাহিনী মােতায়েন করার প্রস্তাব পৌছাতে। কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশ সরকার তাদের ফাঁদে পা দেন নি। ইয়াহিয়ার শিখণ্ডী প্রিন্স সদরুদ্দিনের অভিযান সফল হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের দমন করাই ছিল জাতিসংঘ বাহিনী মােতায়েনের প্রধান উদ্দেশ্য। এখানেও জঙ্গী চক্রের চক্রান্ত সফল হয়নি। অবশেষে জাতিসংঘ প্রেসিডেন্ট উত্থান্ট স্বীকার করেছেন যে সামরিক জোর প্রয়ােগের দ্বারা বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের বিরাট শরণার্থী সমস্যা একটি   আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং এই শরণার্থীরা যাতে তাদের নিজ নিজ গৃহে নিরাপদে ফিরে যেতে পারেন তার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিশ্বের ৫০টি দেশ বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যাকে আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে অভিহিত করেছেন।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৬তম অধিবেশনে ৫০টি দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীবর্গ। এক যুক্ত ইস্তাহারে বাংলাদেশ শরণার্থী সমস্যাকে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।  যুক্ত ইস্তাহারটিতে বাংলাদেশ সম্পর্কিত পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে যে এখনও ভারতে শরণার্থী। আগমন অব্যাহত রয়েছে। শরণার্থীদের দুঃখ দুর্দশা লাঘব করা এবং তারা যাতে নিজেদের ঘরবাড়িতে সম্মানের সাথে ফিরে যেতে পারেন তার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা মানবতার কর্তব্য। এই ছ’মাসের যুদ্ধে আমাদের আর এক বিরাট লাভ পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিপর্যয়। মুক্তি সংগ্রামীদের সাথে ছ’মাস ধরে যুদ্ধ চালিয়ে পাকিস্তানের অর্থনীতির মেরুদন্ড একেবারে ভেঙ্গে গেছে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধেই পাকিস্তানের অর্থনীতি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। তবু বিদেশী সাহায্যের দ্বারা পাকিস্তানের অর্থনীতি কোন মতে খাড়া ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম শুরু করার পর থেকে পাকিস্তানী রফতানীর পরিমাণ শূন্যের কোঠায় এসে দাড়িয়েছে। পাকিস্তান সাহায্য কনসরটিয়ামের সদস্যরা বেঁকে চলেছে। সিনেটের কেনেডী এবং পৃথিবীর বহু দেশ পাকিস্তানকে সবরকম সাহায্য বন্ধ করে দেবার সুপারিশ করেছেন।

পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান সম্পদ পাট আজ আর রফতানী হয় না। বাংলাদেশের চাষীদের অসহযােগিতার ফলে ঔপনিবেশিক বাহিনী পাটের সন্ধান পাচ্ছে না। মুক্তিযােদ্ধারা বন্দরগুলিতে ‘আক্রমণ চালিয়ে জাহাজ ডুবিয়ে দিচ্ছেন। এর ফলে বিদেশী জাহাজগুলাে আর ভিড়তে সাহস পাচ্ছে না। বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলে যােগাযযাগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় মাল চলাচল একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য পুরােপুরি বন্ধ। বিদেশী সংবাদপত্রগুলােতে বলা হয়েছে যে পাকিস্তানে ভয়ানক অর্থনৈতিক বিপর্যয় অবধারিত। গত ১৯শে সেপ্টেম্বর ষ্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান কর্তৃক প্রকাশিত রিপাের্টে একথা জানা গেছে। এই রিপাের্টে বলা হয়েছে গত ৩০ জুন যে আর্থিক বছর শেষ হয়েছে, সে বছর পাকিস্তানের মােট জাতীয় উৎপাদন শতকরা মাত্র ১.৪ ভাগ বেড়েছে। এর আগের বছর বেড়েছে শতকরা ৬.৬ ভাগ। | কৃষি উৎপাদন শতকরা ৬.২ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। এর আগের বছর কৃষি উৎপাদন শতকরা ৮.২১ভাগ বেড়েছিল। গম উৎপাদন শতকরা ১২.৭ ভাগ কমেছে। গত বছর এর উৎপাদন শতকরা ২৯.৭ ভাগ বেড়েছিল। শিল্প উৎপাদন শতকরা ২.৪ ভাগ বেড়েছে। এর আগের বছর বৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ১১.২ ভাগ।  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণকে জঙ্গী চক্রের সাথে কোন রকম সহযােগিতা করার আহ্বান জানিয়ে অসহযােগ আন্দোলন শুরু করেন। তার ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানী পণ্য বর্জন করেছেন। বাংলা দেশের জনগণ দখলদার বাহিনীকে কোন রকম কর বা খাজনা দিচ্ছেন না। ক্ষমতাই মানুষকে অন্ধ করে । ক্ষমতা লােভী ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্রের সুপরিকল্পিত চক্রান্তের ফলেই আজ বাংলাদেশের এই মর্মান্তিক অবস্থা। ডিক্টেটর আয়ুবের বশংবদ ভুট্টো বহুকাল আগে থেকেই পাকিস্তানের গদি দখলের চেষ্টা করেছে। রক্ত লােলুপ ইয়াহিয়াও একই স্বপ্নে মশগুল।  প্রথমে দুজনের মধ্যে আঁতাত হল। নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্যে দুজনেই দু’জনকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। পরে ভুল বুঝাবুঝি-ক্ষমতার দ্বন্দ্বে যা খুব স্বাভাবিক ঘটনা।  

ইয়াহিয়া-ভুট্রো-টিকা-তথা পাকিস্তানী সাময়িক বাহিনীর বিভিন্ন দলে অন্তর্থ দিনে দিনে ভীষণ প্রকট হয়ে উঠছে। যে কোন এক দিন ভােরে উঠে জানতে পারব- তার প্রাক্তন পথ প্রদর্শক ডিক্টেটর ইস্কান্দার মির্জা ও আয়ুবের মত ইয়াহিয়াও পাকিস্তানের রাজনীতির সর্কাস থেকে বিদায় নিয়েছে। | সম্প্রতি ভুট্টো করাচীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছে, অনতিবিলম্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে। ক্ষমতা লােলুপ ভুঠো এতেই ক্ষান্ত হয়নি। সে হুমকী দিয়ে বলেছে এবছরের শেষ দিকে যদি ক্ষমতা হস্তান্তরিত না হয় তাহলে সে ডিরেক্ট এ্যাকশন শুরু করবে।  পাকিস্তানের প্রতি ঘরে ঘরে আজ হাহাকার। কেউ হারিয়েছে ছেলে বা স্বামী। বাংলাদেশে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে নিহত ভাড়াটে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিধবা পত্নীরা সম্প্রতি লাহােরে এই হত্যার প্রতিবাদে এক বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। ভয়ে কোন পাকিস্তানী সৈন্য বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছে না। বালুচ ও পাঞ্জাবী সৈন্যদের মধ্যে বিদ্বেষ শুধু জমছে। যে দিন বিস্ফোরণ হবে তার ভয়াবহ পরিণাম যে কি হবে তা কল্পনা করা যায় না। বাঙালীদের মত বালুচরাও পাঞ্জাবী শাসকচক্রের অত্যাচারের শিকার। প্রতিরােদের জন্যে তারা পাগল। ন্যাপ নেতা ওয়ালী খান পালিয়ে আফগানিস্তান চলে গেছেন। তিনি প্রস্তুত হচ্ছেন প্রতিশােধ গ্রহণের জন্যে। তার পিছে রয়েছে বেলুচিস্তান ও সিন্ধুর শােষিত নিপীড়িত জনগন। রণাঙ্গনে আমাদের মুক্তিবাহিনী শত্রুর বহু অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ আটক করেছে। বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্ণেল উসমানি জানিয়েছেন যে খুব শীগগিরই আমাদের বিমান বাহিনী হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও হাজার হাজার বাঙালি যুবক মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ লাভ করছেন।

আমাদের সবচেয়ে বড় লাভ- আমরা নিজেদের শক্তিকে উপলব্ধি করতে পেরেছি। আমরা বুঝতে পেরেছি। আমরা বুঝতে পেরেছি আত্মনির্ভরশীল না হলে এই শােষণ, নিপীড়নের নাগপাশ থেকে মুক্তি লাভ করা যাবে না। এই উপলব্ধি আমরা অর্জন করেছি দশলক্ষ প্রিয়জনের অমূল্য প্রাণের বিনিময়ে। এবং এই প্রিয়জনের আত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য আমাদের কোন ক্ষতিই বড় নয়। দরকার হলে আরও অনেক রক্ত আমরা দিতে প্রস্তুত। বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকা থেকে শত্রু সম্পূর্ণ উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত এই দশলক্ষ আত্মা শান্তি পাবে না। এই দশলক্ষ আত্মার প্রতি সম্মান দেখাতে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু নিজের জীবনই সব চেয়ে ভাল উপহার। ভিয়েৎনাম যুদ্ধ সম্পর্কে প্যারিস শান্তি আলােচনায় জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের (এনএলএফ) প্রতিনিধি দলের নেত্রী মাদাম বি বীন ভারত সফরে এলে ভারতের প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণমেননকে একটি উপহার দেন। ভিয়েতকংদের বিমান বিধ্বংসী কামানের গােলায় ভূপাতিত মার্কিন বিমানের ধাতুতে তৈরি একটি এ্যাশট্রে। মুক্তি যােদ্ধার কাছে সবচেয়ে দামী বস্তু-মহার্ঘ্য উপহার।  পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু নিজের জীবন। আর যে মাটিতে মায়ের জেঠর থেকে বেরিয়ে জীবনের স্বাদ পেলাম সেই প্রিয় জীবনের বিনিময়ে বালাই দূর হবে আমার জন্মভূমি থেকে। | জীবনের চেয়ে প্রিয় জিনিস জন্মভূমি শত্রু মুক্ত বাংলাদেশ উপহার দেব আমাদের প্রিয়জনদের দশ লক্ষ আত্মাকে।

সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১: ৩

১০ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯