রণাঙ্গনের ডায়েরী থেকে
২৫শে মার্চ-এর দুদিন আগে ২৩শে মার্চ ক্যাপটেন মােতালিবকে গম্ভীর ও চিন্তিত দেখে তার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। তিনি বুঝতে পারলেন আমার কথা + একটু চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে ক্যাপটেন মুতালিব বললেন ঃ আপনারা তাে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে খুব আনন্দ করছেন, আর এদিকে তাে পশ্চিম পাকিস্তানী জন্তরা আপনাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ার জন্যে পুরােদমে তৈরী হচ্ছে-সে খবর রাখেন? প্রশ্ন করলেন তিনি। পরক্ষনেই তার দুটো চোখ জ্বলে উঠল এবং স্বপ্নের ঘােরে যেন আপন মনেই বলে গেলেন, আগে পতাকা না উড়িয়ে আগে আমাদের রাইফেল হাতে নেওয়া উচিত ছিল। | তাঁর ভবিষ্যৎ বাণী যে এমন নির্দয় ভাবে সত্য প্রমাণিত হবে সেটা তখন বুঝতে পারি নি। ২৫শে মার্চ রাতে রক্ত লােলুপ, পাঞ্জাবী জানােয়াররা নিরস্ত্র অসহায় মানুষের উপর অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়ল। তবু আমরা ঠিক ভাবে তাদের-চক্রান্ত আঁচ করতে পারি নি। আমরা তখনও আশা করেছিলাম ২৪ দিনের মধ্যেই হয়ত তাদের এই ধ্বংস অভিযান বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা শুধু প্রতারিত হয়েছি এবং এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় অপাধ। এবং এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত আমরা করছি—আরও কতদিন করতে হবে কে জানে? এখানে ক্যাপটেন মােতলিব এর একটু পরিচয় দেওয়া দরকার।
তিনি পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একজন প্রাক্তন ক্যাপটেন। তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী ছিলেন সিলেট নিবাসী ক্যাপটেন মােতালিব। তখন সিলেট শহর মহাত্রাসে থম থম করছে। রাস্তাঘাট জনমানব শূন্য। দোকান পাট বন্ধ। সিলেটে এখন সান্ধ্য আইন বলবৎ রয়েছে। আমরা বহু উড়াে খবর পাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে রাইফেলের গর্জন শােনা যাচ্ছিল। | সকলেই যে যার বাড়ীতে অধীর ভাবে প্রতীক্ষা করছে-একটা বিরাট কিছুর জন্যে। ইতিমধ্যে আমরা ঢাকা চট্টগ্রাম খুলনা রংপুর প্রভৃতি স্থানে ইয়াহিয়ার নরমেধ যজ্ঞের খবর শুনেছি। আমরা প্রতীক্ষা করছি-উত্তেজনায় বিস্ময়ে আতঙ্কে। ২৬শে মার্চ রাতে দরজায় খুট খুট আওয়াজ হল। সকলেই ভয়ে এবং ত্রাসে বিবর্ণ হয়ে গেল। আমি দরজা খুলতে যাব ভাবছি। কিন্তু মা বারণ করলেন এবং তিনি নিজেই দরজা খুললেন। চেনা লােক দেখে আশ্বস্ত হলাম। ক্যাপটেন মােতালি। কিন্তু ক্যাপটেন মােতালিবের চেহারা দেখে খুব আশ্চর্য হলাম। দেখলাম তিনি উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপছেন। তার সারা গা বেয়ে দর দর করে ঘাম পড়ছে। আলাে আঁধারিতে চোখ দুটো জ্বলছে যেন দুটো জলন্ত বুলেট। উত্তেজিত চাপা স্বরে তিনি বললেন, চলুন, ওরা আমাদের উপর আজ রাতে হামলা করবে। বেরিয়ে এলাম তার সাথে। সারা শহর ঘুটঘুটে অন্ধকার। আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দগুলাে আসছে। খাদিমনগরে ভিলেজ এইড অফিসের সামনে ইপি আর ছাউনিতে এলাম তার সাথে । এখানে এসে দেখলাম সমস্ত ছাউনিটিতে একটা থমথমে ভাব-আসন্ন ঝড়ের আশঙ্কায় সমুদ্রের মাঝে যেন একটা জাহাজ। সবাই তটস্থ। সকলের হাত রাইফেলের ট্রিগারে পেপে রয়েছে। সকলেই ঘড়ি দেখছেন। প্রতীক্ষায়। প্রতিটি মুহূর্তকে অনন্তকাল মনে হচ্ছিল। এই ছাউনিটিতে আমাদের সৈন্যসংখ্যা ছিল একশ’র বেশী।
রাত তখন দুটো। একসাথে রাইফেল আর মেসিনগান গর্জন করে উঠল। অন্ধকারের মধ্যে শুধু-জলন্ত বুলেটের ঝাক দেখতে পাচ্ছিলাম। আমাদের মুক্তি যােদ্ধার তার পাল্টা জবাব দিয়ে চললেন। পাকিস্তানী সৈন্য সংখ্যা আমাদের চেয়ে ৪/৫গুণ বেশী ছিল। ক্যাপটেন মােতালিবকে দেখলাম তিনি ঝড়ের বেগে ঘুরে ঘুরে সবাইকে নির্দেশ দিচ্ছেন। আমাদের দুর্ধর্ষ যােদ্ধাদের পাল্টা মার যে এমন তীব্র হবে হানাদার বাহিনী সেটা আন্দাজ করতে পারেনি। পাল্টা আক্রমণে তারা বানচাল হয়ে পড়ে। বেগতিক দেখে তারা পিছু হটতে থাকে। রাত দুটো। থেকে সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত এই সংঘর্ষ চলে। পাকিস্তানীদের তাড়িয়ে আমরা শিবগঞ্জ বাজার পৰ্য্যন্ত নিয়ে এলাম। সকালে তাদের দেখা পেলাম না। দুটি পাঞ্জাবী কুত্তার লাস পাওয়া গেল। হানাদান বাহিনীর অবস্থা তখন আহত সাপের মত। প্রতিহিংসা নেবার জন্যে তারা অন্ধকারের প্রতীক্ষায় ছিল। আমরা খবর পাচ্ছিলাম তারা সর্বাত্মক আক্রমণ করার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এবারে তাদের সংখ্যাও অনেক বেশী হবে। এবং আজকেই তারা সে সুযােগ নেবে কারণ তারা জানে আমাদের সৈন্য সংখ্যা, অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ তাদের তুলনায় অনেক কম। তারা আমাদের কোন সময় দেবে না—আমাদের ঘাটতি পূরণ করতে। “তথাস্তু, এটাই হবে আমাদের অগ্নি পরীক্ষা। ক্যাপটেন মােতালিব-এর চিন্তাকিষ্ট চেহারায় একটা প্রত্যয়ের আলাে উষ্কাষিত হল। তিনি বললেন। আমরাও চাই শক্র আমাদের উপর হামলা করুক। সারাদিন ধরেই বুলেটের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। দুচারটা জঙ্গী বােমারু বিমানও উড়ে যেতে দেখলাম। দিগন্তে দেখা গেল ধোঁয়ার কুণ্ডলী। আমরা সকলেই যে যার জায়গায় চুপচাপ বসে আছি। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামছে আর গুলীর আওয়াজ প্রকট হচ্ছে।
এর মধ্যেই একজন হােট ট্রানজিসটর বের করলাে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আবৃত্তি চলছিল। আবৃত্তি নয়ত যেন আগুন ঝরছিল …বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাটি বুঝেনি দুবৃত্ত…।। মদের মত সেই স্বরের আগুন যেন আমাদের রক্তের মধ্যে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। আমাদের | চোখগুলাে ছােট হয়ে এসেছে-দৃষ্টি প্রখর ও সীমিত। লক্ষ্য শুধু-শত্রুর বুক। ট্রিগারের উপর আমাদের হাত নিশপিস করছে-শরীরের আগুন জ্বলছে। | অধিনায়ক ক্যাপটেন মােতালিব এর আদেশের প্রতীক্ষায় সব সুপ্ত বিস্ফোরনুখ আগ্নেয় । ক্যাপটেন মােতালিব বলছেন, আমাদের গুলীর পরিমাণ কম, কোন অপচয় আমরা করতে পারব না। প্রতিটি বুলেট কাজে লাগাতে হবে। ওরা চালিয়ে যাক সমানে-আমাদের একটি দুটি বুলেটই ওদের একশ দুশর সমান। আমাদের আর বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না—আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পাল্টা গুলী শুরু করব।’ ক্যাপটেন মােতালিব বলে যাচ্ছেন। হানাদার বাহিনীর মেসিনগনি ও অন্যান্য স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়ন্ত্রের নলের আগুন সুস্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ওরা প্রায় আমাদের গুলীর রেঞ্জের মধ্যে এসে গেছে। হাত নিসপিশ করছে কিন্তু আদেশ না পেলে চুপ করে থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই। অন্ধকারের মধ্যেও তখন ওদের চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। ফায়ার, ক্যাপ্টেন মােতালিবের কণ্ঠে বজ্র নির্ঘোষের মত শক্র ধ্বংসের আদেশ ধ্বনিত হল। তারপর আর কোন খেয়াল নেই। শুধু একটি কথাই মনে ছিল-শক্র হত্যা করতে হবে।
মাথার উপর দিয়ে কানের পাশ দিয়ে ঝাকে ঝাকে গুলী চলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ওদের ফেয়ারের আলাে জ্বলে উঠছে-অন্ধকারে। কানে তালা লাগার উপক্রম মর্টারের বিকট শব্দে। মুরারী চাঁদ কলেজ ও টিবি হাসপাতালের সামনে এই সংঘর্ষ চলল। উচু টিলা গাছপালা এবং অন্ধকার আমাদের খুব সাহায্য করছিল। অনভ্যস্ত হানাদার সৈন্যরা আমাদের পাল্টা আক্রমণের মুখে ঝাকে ঝাকে ঘায়েল হচ্ছিল। সারারাত ধরে চলল এই পশু হত্যার উৎসব। আস্তে আস্তে আবার ভাের কিন্তু আমাদের কোন ক্লান্তি বা বিরাম নেই। আমাদের একান্তই লক্ষ্য শক্রর বুক। সারাদিন ধরে চলল অবিরাম গুলী বর্ষণ। আবার সন্ধ্যা হল। বিঘ্নিত অন্ধকার । জোনাকির মত গুলীর জ্বলছে দূরে, চারিদিকে। আমাদের আক্রমণ একটু জোরদার করা হল। আগের দিনের মত ওদের গুলীর আওয়াজ খুব বেশী প্রখর মনে হল না। আমরা ভেবেছিলাম ওদের আক্রমণ আজ প্রবলতর হবে। যুদ্ধ চলছে। মধ্য রাতের দিকে গুলীর আওয়াজ স্তমিত হয়ে আসছিল-নাকি আমার তন্দ্রার ভাব হয়েছিল। একটু হয়ত অন্য মনস্ক হয়েছিলাম-একঝাক গুলী কানের পাশ দিয়ে সাঁ সাঁ করে বেরিয়ে গেল। থুবড়ে মাটির মধ্যে পড়ে গেলাম-কিছুক্ষণ পরে সম্বিত ফিরে পেলাম। দেখলাম পূর্ব দিগন্ত লাল হয়ে উঠেছে। গুলীর আওয়াজ স্তিমিত। প্রত্যুষের অবস্থা আলােয় দেখলাম দলে দলে হানাদার বাহিনীরা পালাচ্ছে। তখন ওদের সংখ্যা আন্দজ করতে পারছিলাম। আমাদের চেয়ে ওদের সংখ্যা অনেক গুণ বেশী ছিল। | বিগত ৪৮ ঘণ্টা আমরা অবিরাম যুদ্ধ করছি। আমাদের পক্ষে কয়েকজন আহত হয়েছে। নিহতের সংবাদ তখনও পাইনি। ক্যাপটেন মােতলিবর মুখে সাফল্যের হাসি। তিনি জানালেন আমরা ২৫০-২৭৫ জন শত্রু খতম করেছি। ট্রানজিসটর আবার মুখর হয়ে উঠেছে। ক্যাপটেন মােতালিব সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর কণ্ঠস্বর-স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গলার মধ্যে গলা মিলিয়ে বললেন বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাটি…. …বুঝে নিক দুবৃত্ত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনছেন।
সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১: ৩ ॥
১০ অক্টোবর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯