পূর্ব ও পশ্চিম রণাঙ্গনে হানাদার দস্যুদের নাভিশ্বাস
ঢাকা জেলার আরাইহাজার থানাধীন কামসদিচার এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে ১১ জন হানাদার সৈন্য খতম হয়। এই অঞ্চলের একটি বাড়ী থেকে গেরিলাযােদ্ধারা ২৪ জন গ্রাম্যবালিকাকে উদ্ধার করেন। এদের পাকিস্তানী দস্যু সৈন্যরা আটক করেছিল। কুমিল্লা-নােয়খালীতে বহু খানসেনা হতাহত গত ৩০শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের কুমিল্লা-নােয়াখালী অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাযােদ্ধারা কয়েকটি রেল সেতু ও কালভার্ট উড়িয়ে দেওয়ার ফলে কুমিল্লা ও নােয়াখালীর মধ্যে যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর হাতে ৫১ জন পাকিস্তানী সৈন্য খতম হয়। উত্তর কুমিল্লার আনন্দপুরে গেরিলারা তিনজন কুক্যাত রাজাকারসহ ৮ জন দস্যু খতম করেন। মনােবল নিজেদের প্রতি অবিচল আস্থা ও উদ্দেশ্যের সততার প্রয়ােজন তার কোনটাই এখন আর দখলদার বাহিনীর মধ্যে নেই। সামরিক ভাষ্যকারদের মতে এর কারণ ত্রিবিধ। প্রথমতঃ লুঠতরাজ, নারী ধর্ষণ প্রভৃতি কাজ করে। পশ্চিমাসৈন্যরা তাদের পেশাদার সৈনিকের চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। ৮০/১০০ টাকার সেপাই বাড়ীতে লাখাে লাখাে টাকা পাঠিয়েছে। সুতরাং যুদ্ধ করে প্রাণে মারা গেলে টাকা খাবে কে-এ চিন্তায় তারা আর এখন যুদ্ধ করতে চায় না, তারা যুদ্ধ-বিমুখ হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয়তঃ যুদ্ধে মারা গেলে বা আহত হলে ইনসুরেন্সের টাকা পাওয়ার যা বিধান ছিল ইয়াহিয়ার কাণ্ড কারবারে তা ভেস্তে গেছে। সর্বশেষে যে বিষয়টা ইয়াহিয়ার ভাড়াটিয়া সৈন্যদের মনােবল একেবারে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে তা হল আমাদের মুক্তি বাহিনীর শত্রুর উপর আঘাত হানার মতা, ক্ষিপ্র গতি এবং ক্রমবর্ধমান শক্তি। প্রথম দিকে তাদেরকে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার যুদ্ধ জয়ের আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবের কঠোর আঘাতে তারা আজ বুঝতে পারছে যে ৪৮ বছরেও তাদের পক্ষে বাংলাদেশে যুদ্ধ জয়ের কোন সম্ভাবনা নাই। পাকিস্তান বাহিনীর মনােবল ভেঙ্গে পড়ার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে সাবেক পাকিস্তানের আমলে স্থাপিত ২২৫টি প্রহরা ফাড়ির ১৭১টি থেকে তাদের সরে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে আশ্রয় গ্রহণ থেকে। যে ৫৪ টিতে তারা এখনও অবস্থান করছে তাতেও তারা নিয়মিত থাকে না। মুক্তি বাহিনীর আগমণ-বার্তা পেলে পালিয়ে যায় এবং পরে সুযােগ মত আবার এসে দখল নেয় । সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে বিগত মাস দেড়েকের মধ্যে ৪/৫ হাজার সৈন্য হতাহত হওয়া ছাড়াও অন্য একটি কারণ তাদের ভগ্নপ্রায় মনােবলকে আরাে ভেঙ্গে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে। বিষয়টা হল মুক্তি বাহিনীর হাতে পাকিস্তানী ও বিদেশী মিলিয়ে ডজন খানেকেরও বেশী জাহাজ, স্টীমার ডুবি। বস্তুতঃ যে ভাবে ও যে পদ্ধতিতে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডােরা জাহাজ ও স্টীমারগুলাে ডুবিয়ে দিয়েছে তা যে কোন জাতির জন্য গর্বের বিষয়। গত ১৬ই আগষ্ট মুক্তি বাহিনী প্রথম চট্টগ্রাম বন্দরে মজিনের সাহায্যে দু’খানা জাহাজ ধ্বংস করে দেয়। তার মধ্যে একখানা ছিল পশ্চিম জার্মানীর এবং অপরটি ছিল লাইবেরিয়ার। তার পর ১৬ই আগষ্ট রাত থেকে ২২শে আগষ্টের মধ্যে যুগপৎ আক্রমণ চালিয়ে মুক্তি বাহিনী খুলনা, চালনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে ছােট বড় মিলিয়ে পুরা এক ডজন জাহাজ, চীমার ও স্পীড বােট বিনষ্ট করে।
এর মধ্যে একখানা আমেরিকান জাহাজ এবং পাকিস্তানী জাহাজ ‘পদ্মা’ ‘সুন্দরবনও ছিল। শেষােক্ত জাহাজেয় মার্কিন মুল্লুক থেকে বাঙ্গালী হত্যার জন্য অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে চালনায় এসে নােঙ্গর করেছিল। সর্বশেষে গত সপ্তাহে চালনা বন্দরে মুক্তি বাহিনী আরেক খানা মার্কিন জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে তথাকথিত পাকিস্তানের গােয়েবলসরা বােধগম্য কারণে পূর্বেকার জাহাজগুলাে ডুবিয়ে দেওয়ার কথা বেমালুম চেপে যায়। অস্ত্রবাহী জাহাজ মুক্তি বাহিনী ডুবিয়ে দিয়েছে এ সংবাদ শুনলে বাঙ্গালীদের মন আনন্দে নেচে উঠবে আর পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ আসল ব্যাপার জেনে ফেলবে সেই কারণেই তারা এতবড় ক্ষতির কথা চেপে গিয়েছিল। কিন্তু সর্বশেষ জাহাজ ডুবির কথা তারা নানা কারণে চেপে যেতে পারেনি। এর প্রথম কারণ হল। ঘােয়েবলসীয় প্রচারণার ধারা। মুক্তি যােদ্ধারা খাদ্যবাহী জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে এ সংবাদ শুনলে। বাংলাদেশের মানুষ মুক্তি বাহিনীর উপর ক্ষেপে যাবে মনে করেই তারা ঘটনাটা স্বীকার করেছে। দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তানে ভাড়া খাটতে এসে বার বার জাহাজ ধ্বংসের ফলে কোন কোন বৃটিশ ও মার্কিন জাহাজ কোম্পানী নাকি পাকিস্তান সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে যে ক্ষতিপূরণ না দিলে অতঃপর তারা আর কোন জাহাজ বাংলাদেশের বন্দরে পাঠাবে না। অথচ সরকারীভাবে জাহাজ ধ্বংসের কথা স্বীকার করা না হলে তারা ইনসুরেন্স কোম্পানীর কাছ থেকে ক্ষতিপুরণও পেতে পারে না। তাই ঠেলায় পড়ে ইয়াহিয়া এবার জাহাজ ডুবির কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। অবশ্য এ ঘােষণার পরও বৃটিশ বা মার্কিন নাবিকরা নিজেদের জানের উপর ঝুঁকি নিতে আসবে বলে মনে হয় না।
সামরিক মহলের মতে এ সমস্ত জাহাজ ডুবি অন্যভাবেও ইয়াহিয়ার যুদ্ধ-প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করে। তুলেছে। এতদিন সমুদ্র পথই ছিল ইয়াহিয়ার বাংলাদেশে সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ প্রেরণের প্রধানতম অবলম্বন। কিন্তু বর্তমানে তাও অকেজো হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। সুতরাং সৈন্য আনতি দূরের কথা, চরম বিপদের মুখে পশ্চিমা সৈন্যদের বাংলাদেশ থেকে পালাবারও দ্বিতীয় কোন উপায় আর থাকবে না । তাই যারা এতদিন ভাবছিলেন যে বর্ষা শেষে পাকিস্তানী বাহিনী বাংলাদেশে মুক্তি বাহিনীর উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে তাদেরকে নাস্তানাবুদ করতে পারবে তারা এখন মত পাল্টাতে শুরু করেছেন। কেননা, গত কয়েক মাসে মুক্তি বাহিনী যেভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচলের পথ ও সরবারাহ লাইন চুরমার করে দিয়েছেন তাতে পশ্চিমা সৈণ্যদের পক্ষে বড় বড় কলাম নিয়ে আর অভিযান পরিচালনা সম্ভব হবে। দ্বিতয়িতঃ মুক্তি বাহিনীর লােক সংখ্যা গত মার্চ-এপ্রিলের তুলনায় আজ বহুগুণে বেশী, এবং তারা বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে দুড়িয়ে আছে। পশ্চিম পাকিস্তানীদের তুলনায় তাদের গেরিলা ট্রেনিং উন্নতমানের। এমতাবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদেরকে বর্ষাশেষে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে যুদ্ধ করতে হবে। তাতে তাদের প্রাণ দিতে হবে গত মার্চ, এপ্রিলের চেয়েও অনেক বেশী হারে। অথচ সেই মানসিকতা আজ আর পশ্চিমা সৈন্যদের নাই। তদুপরি বর্ষাশেষে হানাদার বাহিনীর পক্ষে যেমন ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চলাচল করা সহজতর হবে। তেমনিভাবে মুক্তিবাহিনীর পক্ষেও ভারী অস্ত্রশস্ত্র ভেতরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। সুতরাং সমানে সমানে যুদ্ধ সব সময়ই মুক্তি বাহিনীর পক্ষে যাবে। কেননা, হানাদার বাহিনী আজ আর কামান, মার্টার প্রভৃতির একচেটিয়া অধিকারী নয়। মুক্তি বাহিনীর হাতেও বর্তমানে এসব রয়েছে।
জয়বাংলা (১) ১ : ২২ !
৮ অক্টোবর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯