জয় নিপীড়িত প্রাণ! জয় নব অভিযান জয় নব উত্থান
বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর সাফল্য। বিপুল পরিমাণ শত্রুসৈন্য হতাহত। ২৬ বছর বয়স্ক তরুণ সেনানী নিজামুদ্দীনের অভূতপূর্ব বীরত্ব। দুশমনদের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার । পাঠান ও বালুচরা বাঙালীর খুনে হাত রঙাতে তারা রাজী নয়। পাঞ্জাবীরা পালিয়ে যাওয়ার পূর্বে মরণ কামড় দেওয়ার চেষ্টায় রত। রেজাকারদের ভাঙন। নিজস্ব বার্তা পরিবেশক-৪ঠা সেপ্টেম্বর তারিখে সিলেট জেলার কানাইঘাট ও জকিগঞ্জের মধ্যবর্তী এলাকায় মাত্র ৪২ জন অকুতােভয় মুক্তিসেনার একটি ক্ষুদ্র দল আধুনিক চীনা ও মার্কিন অস্ত্রে সজ্জিত শত্রুবাহিনীর সংগে সামনা সানি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় এবং মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে সাফল্যের আরেকটি রেকর্ড স্থাপন করেছে সংবাদে প্রকাশ, যুদ্ধ শুরু করে কয়েক ঘণ্টা লড়ার পর মুক্তিযােদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে শত্রুবাহিনী পিছনে হটে যেতে বাধ্য হয়। তখন তাদের ১৬ জন নিহত হয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তারা নতুন সৈন্য দ্বারা দল ভারী করে নেয় এবং মুক্তিযােদ্ধাদের ক্ষুদ্র দলটিকে ঘেরাও করে ফেলে। দলের অধিনায়ক ২৬ বছরের তরুণ কুমিল্লার বীর সন্তান খাজা নিজামুদ্দীন তখন বলিষ্ঠকণ্ঠে তার ক্ষুদ্র বাহিনীটিকে বলেন, ‘প্রিয় ভায়েরা আমার, শত্রুদের হাতে ধরা পড়ার চেয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়াই শ্রেয়। যুদ্ধক্ষেত্রে বীর পুরুষেরা তা-ই করে থাকেন। সুতরাং নিরাপদ স্থানে ফিরে যেতে নাপারা পর্যন্ত ওদের সংগে আমরা লড়বাে। আবার তীব্র লড়াই শুরু হয়। কিছুক্ষণ পরেই শত্রুপক্ষের একটি গুলি এসে নিজামুদ্দিনের পায়ে বিদ্ধ হয়। কিন্তু বীর নিজাম নিজের দিকে দ্রুক্ষেপ না করেই অনবরত মেসিনগানটি চালাতে থাকেন এবং নিজের দলটিকে হুকুম দেন পিছনের দিকে হটে যেতে। তাঁর দলটি নিরাপদস্থানে এসে পৌছতে সক্ষম হয়। এবং তখন শত্রু সৈন্যের আরেকটি গুলি এসে তার গলায় বিদ্ধ হয়। নিজাম ঢলে পড়েন। কিন্তু
ঢলে পড়ার পূর্বক্ষণে এই বীর তরুণ সেনানীর মুখ দিয়ে বের হয় : ‘জয় বাংলা।’ | তার মুখে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি শুনে ও তাকে ঢলে পড়তে দেখে পিছনে হটে আসা তার ক্ষুদ্রবাহিনীটি প্রথমে চমকে ওঠে। পরমুহুর্তেই কিন্তু নিজেদের কর্তব্য স্থির করে নেয় তারপর বীরত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে শত্রুপক্ষের অবিরাম গুলি বর্ষণের মধ্য দিয়েই দলপতির লাশটি যুদ্ধত্রে থেকে তুলে নিয়ে আসে। শত্রুদের বিপুল সংখ্যাক হতাহত হয়েছে। শহীদ নিজাম উদ্দিন এম, এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরা ছাত্রদের অন্যতম ছিলেন। ১৮ই সেপ্টেম্বর কমলপুরের সীমান্তবর্তী এলাকায় ধলাই চাবাগানে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা এক অতর্কিত হামলা চালিয়ে একটী প্রকান্ড গাছের ওপর বসে ও-পি কার্যে রত দুজন হানাদারকে গুলি করে নীচে ফেলে দেন। তারপর যখন তারা ঐ লাশ দুটোকে ধরে নিয়ে আসার জন্য অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন একটা জীপভর্তি হানাদার সৈন্য এসে পৌঁছে। গেরিলারা জীপের ওপর গ্রেনেড ছুঁড়ে মারেন। ফলে ৭ জন হানদার শত্রু নিহত হয় এবং জীপখানা ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯শে ও ২০শে সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনী উক্ত ধলই সেক্টরে সৈন্যদের কয়েকটা পাকা বাংকার ধ্বংস করে দেয়। ১২ জন শক্র ও ৬ জন রেজাকার এ সংঘর্ষে নিহত হয়। দুশমনদের অনেকগুলাে অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়েছে সেম সাইড।
১৯শে সেপ্টেম্বর রানা সীমান্তে ফুলতলা চা বাগানে একদল রেজাকার ও পাক সৈন্যের মধ্যে এক তুমুল সংঘর্ষ হয়। উক্ত সংঘর্ষে ৮ জন পাক সেনা নিহত ও কয়েকজন আহত হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর সংগে যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক রেজাকারদেরকে সংগে পাক সৈন্যের উক্ত সংঘর্ষ ৩ ঘণ্টাকাল ব্যাপী চলে। বিদ্রোহী রেজাকারগণ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে। ১৯শে সেপ্টেম্বর জৈন্তাপুর এলাকায় মুক্তিফৌজের সহিত এক সংঘর্ষে ১৭ জন শত্রু সৈন্য নিহত ও ৯ জন আহত হয়েছে। ২১শে সেপ্টেম্বর ডাউকী সেক্টরে এক সংঘর্ষে মুক্তিফৌজ দুই গাড়ী ভর্তি শত্রুসৈন্যকে খতম করে দিয়েছে এবং কাঠালপুর ও সড়কের বাজারের পুলগুলাে ভেঙ্গে দিয়েছে। বিভিন্ন ঘাটী থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, পাঞ্জাবী, বেলুচ ও পাঠানদের মধ্যে অন্তৰ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। পাঠানরা ক্যাম্পগুলাে থেকে বের হােন না। বাঙালীদেরকে খামকা হত্যা করতে তারা রাজী নন। ভয়ে পাঠানদেরকে কিছু বলতে পারে না পাঞ্জাবীরা। বেলুচরাও যুদ্ধ করতে তেমন আগ্রহী নয়। প্রায় তাদের সঙ্গে তর্ক বিতর্ক থেকে শুরু করে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়ে থাকে পাঞ্জাবীদের এবং বেলুচ অফিসারদের আদেশ পালন করতে অস্বীকার করে পাঞ্জাবীরা।
মুক্তবাংলা ১: ৩
৪ অক্টোবর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯