রণাঙ্গন থেকে
(নিজস্ব প্রতিনিধি) গত মাসের প্রথম সপ্তাহ হইতে লালমনিরহাট শহর লক্ষ্য করিয়া মুক্তিযােদ্ধারা গেরিলা আক্রমণ জোরদার করিয়াছে। বিশেষ করিয়া এখানে অবস্থিত সামরিক যােগাযােগের দিক হইতে গুরুত্বপূর্ণ বিমান অবতরণ ক্ষেত্রের চারি পাশে গেরিলারা হানাদার শত্রুদের অবিরাম ব্যতিব্যস্ত রাখিয়াছে। ৮ই সেপ্টেম্বর শহরের উপকণ্ঠে দুরাকুঠি হইতে গেরিলারা শহরে শত্রু ঘাটির উপর আক্রমণ চালাইয়া হানাদার বাহিনীর প্রভূত ক্ষতি সাধন করে। পাক বাহিনী তাহাদের ঘাটি লালমনিরহাট কলেজের নব নির্মিত ভবনের ছাদ হইতে মর্টার ও মেশিনগানের একটানা গােলা বর্ষণ করিয়া এই আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে, কিন্তু গেরিলাদের কোনও ক্ষতি করিতে পারে নাই। গেরিলাদের সন্ধান না পাইয়া বর্বর হানাদাররা পরদিন শহরের কাছে পূর্ব দোলাজোর গ্রামে। ৭০/৮০টি বাড়ি জ্বালাইয়া দেয় ও ৮/১০জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। কিন্তু ইহাতেও শত্রুরা গ্রামবাসীদের মনােবল ভাঙিতে পারে নাই, গেরিলা আক্রমণও বন্ধ হয় নাই। ১০ই সেপ্টেম্বর তােলাবাড়ি হাটে গেরিলারা কয়েকজন পাক সেনা ও রাজাকারকে হত্যা করে। ঐ দিন মােগলহাটে শত্রুসেনাদের একটি শক্ত বাংকার মুক্তিবাহিনী বিধ্বস্ত করে। ইহার প্রতিশােধ লইতে হানাদার বাহিনী মােগলহাটের কেটু মিয়াকে হত্যা করে। ১৪ই সেপ্টেম্বর তিস্তা স্টেশনের কাছে রাতিপুর গ্রামে রেল লাইনে মাইন বিস্ফোরণ ঘাটাইয়া মুক্তি বাহিনী শক্র বােঝাই একটি ট্রেনের ক্ষতি সাধন করে। ইহাতে ২২ জন শত্রুসেনা নিহত হয়।
১৫ই সেপ্টেম্বর লালমণিরহাট আদিতমারি রেল স্টেশনের মধ্যবর্তী সরলামতি রেল সেতু দখল করার জন্য মুক্তিবাহিনী প্রাণপণ লড়াই চালায়। প্রবল আক্রমণের মুখে শত্রুপক্ষ তাহাদের অবস্থান। পরিবর্তন করিতে বাধ্য হয়। এই লড়াইয়ে ৪ জন রাজাকার মুক্তি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। এই অঞ্চলে, এক কুখ্যাত ডাকাতের সর্দার বকতার আলী রাজাকারদের নেতৃত্ব করিতেছে। সে। তাহার ঘােড়ায় করিয়া গ্রামাঞ্চলে শত্রুপক্ষকে রসদ সরবরাহ করে। মুক্তিবাহিনী তাহার বাড়িতে হানা দিয়া ঐ ঘােড়াটি ও একটি মােটর সাইকেল হস্তগত করিয়াছে। নবীনগরে গেরিলাদের বিরাট সাফল্য। গত ১৭ই সেপ্টেম্বর নবীনগরে এক সংঘর্ষে ৭০ জনের বেশি পাকিস্তানী হানাদার সৈন্য খতম এবং প্রচুর অস্ত্র ও গােলাবারুদ মুক্তিবাহিনীর হাতে আসিয়াছে। ঐ দিন নবীনগর থানার মেহেরি, সিমরাইল ও কাইতলা গ্রামে হানাদার বাহিনীর শতাধিক সৈন্যের একটি দল ১৫ জন রাজাকার সঙ্গে লইয়া নৌকাযােগে গেরিলাদের খুজিতে আসে। তাহাদের কয়েকজন সিমরাইল গ্রামে এক বাড়িতে উঠিয়া মুক্তিবাহিনী সন্দেহে বাড়ির কয়েকজন লােককে বেদম প্রহার করে এবং বাড়িতে আগুন লাগাইয়া লুঠতরাজ শুরু করে। গেরিলারা নিঃশব্দে আসিয়া বাড়িটি ঘিরিয়া ফেলে ও চারিদিক হইতে গােলাবর্ষণ করিয়া অধিকাংশ শক্রসেনাকে খতম করে। ইহার কিছু দূরে মেহেরি ও সেমরাইলের মধ্যবর্তী এলাকায় গেরিলাদের একটি দল শত্রু পক্ষের নৌকা বহরের উপর আক্রমণ করে। সকাল ১০টা হইতে দুইটা পর্যন্ত উভয় পক্ষে তুমুল গােলাগুলি চলে। মুক্তিযােদ্ধাদের গােলাবর্ষণে তিনটি নৌকা উলটাইয়া যায় ও ৭০ জন পাক সৈন্য নিহত হয়। অন্যান্যরা তড়িৎগতিতে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে। মুক্তি বাহিনী দুই জন শত্রুসেনাকে বন্দী করিয়াছে। এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী ১০টি স্বয়ংক্রিয় চীনা রাইফেল, ৭টি রাইফেল, ২ পেটি গোলাবারুদ ও একটি ক্ষতিগ্রস্ত ওয়্যারলেস সেট উদ্ধার করিয়াছে। শত্রুপক্ষের নৌকাডুবির ফলে আরও অনেক অস্ত্রশস্ত্র নদীতে নিমজ্জিত হইয়াছে বলিয়া ধারণা করা হইতেছে।
ময়মনসিংহ-সিলেট রণাঙ্গন বাঙলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর সূত্রে জানা গিয়াছে ময়মনসিংহ-সিলেট-মৌলভীবাজার রণাঙ্গনে গত ২০ শে সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণে সিলেটের রাধানগর এলাকায় শত্রু-পক্ষের ৫ জন খতম হইয়াছে। ১৯শে সেপ্টেম্বর এই রণাঙ্গনে বেশ কয়েকটি গেরিলা অভিযান চালানাে হয়। এই সব অভিযানে মণিপুর ও লাখীপুরে ৩ জন ও বরাগ : শক্র ছাউনিতে ৫ জন হানাদার খতম হইয়াছে। বেরিগাঁও ও বাদারটেকে গেরিলারা শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করে। ইহাতে ৫ জন শত্রুসৈন্য খতম হয়। ১৮ই সেপ্টেম্বর জয়ন্তীপুর এলাকায় শত্রুসেনা ও রাজাকারদের উপর আক্রমণ চালাইয়া গেরিলারা ৪ জন হানাদার ও বহু রাজাকারকে খতম করিয়াছেন। ঐ দিন মুক্তিবাহিনী রাজকী চা বাগান ফ্যাক্টরিতে আক্রমণ চালায়। ১৩ই সেপ্টেম্বর হইতে ১৭ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী শাহবাজপুর চা-বাগান এলাকায় আক্রমণ চালাইয়া ৮ জন শত্রু সৈন্যকে হত্যা করেন। * গত ১৫ই ও ১৮ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে মুক্তিবাহিনী ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, কলমাকান্দা, শ্রীবর্দী, ইসলামপুর ও নালিতাবাড়ি থানার সদর দপ্তরগুলিতে অভিযান চালাইয়া ১০ জন পাকিস্তানী মিলিটারি পুলিশকে খতম করেন।
রংপুর-দিনাজপুর-রাজশাহী রংপুর-দিনাজপুর-রাজশাহী রণাঙ্গনে গত ১৮ ও ১৯ তারিখে কয়েকটি অভিযানে পাথরঘাটা, মােগলহাট ও উদয়শ্রীতে ৬ জন শত্রুসৈন্য খতম হয়। ইতিপূর্বে মুক্তিবাহিনী গত ১৬ই সেপ্টেম্বর ঐ এলাকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কসেতু উড়াইয়া দেন ও মহেন্দ্রনগর এলাকায় হঠাৎ আক্রমণে এক জন শত্রুসৈন্য নিহত হয়। বিলম্বে পাওয়া খবরে জানা গিয়েছে, ১৫ই সেপ্টেম্বর রংপুরের কাছে গেরিলারা ট্রেনের একটি ইঞ্জিনসহ ২টি বগি বিধ্বস্ত করেন। | ঢাকা-কুমিল্লা চট্টগ্রাম রণাঙ্গনে খাজুরিয়া এলাকায় গত ১৬ই সেপ্টেম্বর গেরিলারা শত্রুসৈন্যের উপর। আক্রমণ চালাইয়া ২ জন পাক সেনা ও ২ জন রাজাকারকে খতম করিয়াছে। ঐ দিনই হুগলীগ্রামে গেরিলারা পাক সৈন্য ঘাটির উপর আক্রমণ চালাইয়া ৩ জনকে খতম ও কমপক্ষে ২০ জনকে আহত কুষ্টিয়া-যশাের-খুলনা কুষ্টিয়া-যশাের-খুলনা রণাঙ্গনে গত ১৭ই সেপ্টেম্বর পালিয়া এলাকায় মুক্তিবাহিনী ২ জন পাকিস্তানী সৈন্য খতম করেন এবং সােনাবাড়িয়া-মান্দ্রা সড়কে শত্রুসৈন্যবাহী একটি জীপ ও একটি লরি বিধ্বস্ত করিয়া অপরাপর সূত্রে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে গত ১১ ও ১৪ই সেপ্টেম্বর ভারী মর্টার আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা ৬৩ জন শত্রুসৈন্যকে খতম করিয়াছেন।
মুক্তিযুদ্ধ ১১: ১৩
৩ অক্টোবর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯