You dont have javascript enabled! Please enable it!

দৈনিক ইত্তেফাক
২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
শান্তি চাই আর চাই শৃংখলা : শেখ মুজিবুর
(ষ্টাফ রিপোর্টার)

গতকল্য (শনিবার) তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহৃত হওয়ায় আটকাবস্থা হইতে মুক্তিলাভের স্বল্পক্ষণ পরে স্বীয় বাসভবনের দ্বিতল বারান্দায় দাঁড়াইয়া সমবেত জনসমুদ্রকে উদ্দেশ করিয়া শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, তাঁহার মুক্তি লাভে দেশবাসীর বিজয় সূচিত হইয়াছে। তিনি আরো বলেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ এক অভিন্ন ও ঐক্যবদ্ধ। শেখ মুজিব বলেন যে, ছাত্র-জনতার এ ত্যাগ, তিতিক্ষা ও আত্মাহুতি কখনও বিফলে যাইবে না। -যাইতে পারে না।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া সংগ্রামের প্রতিশ্রুতি দিয়া শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, দেশবাসীর প্রতিটি দাবী লইয়া তিনি অবিরাম সংগ্রাম করিয়া যাইবেন; কেননা, তিনি বিশ্বাস করেন যে, দেশ ও দেশবাসীর অধিকার ও স্বার্থের স্থান সর্বোচ্চ।
দেশের উভয়াংশের ছাত্র-জনতা যেভাবে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাঁহার মুক্তির জন্য সংগ্রাম করিয়াছে সেজন্য তিনি দেশবাসীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
শেখ সাহেব বলেন, জনগণ এক মহান লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন, জাতি কোনদিন তাহা বিস্মৃত হইবে না।
দৃপ্তকণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেন যে, দেশবাসীর দাবীদাওয়ার প্রশ্নে তিনি পর্বতের মত অটল আছেন এবং তিনি মনে করেন যে, দেশবাসীর অধিকার পুনরুদ্ধারের প্রাক্কালে ব্যক্তি বা গোষ্ঠি স্বার্থের উর্ধ্বে স্থান দিতে হইবে। এক পর্যায়ে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে শেখ মুজিব বলেন যে, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করিতে গিয়া যে সূর্য-সন্তানেরা অকালে হৃদয় নিংড়ানো রক্তে রাজপথ রাঙ্গাইয়া গেলেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর ভাষা আমার নাই। আজকের দিনে কোটি কণ্ঠের সংগে কণ্ঠ মিলাইয়া আমিও বলি, “জয়-ছাত্র-জনতার জয়।”
অগণিত ভক্তের প্রেম-ভালবাসার অনির্বাণ শিখার সামনে আকণ্ঠ মাল্যভূষিত হইয়া শেখ মুজিব দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, সংগ্রামী ছাত্ররা যে ১১ দফা দিয়াছেন তার প্রতি আমারও সমর্থন রহিল। কারণ ১১ দফার মধ্যে আমার দলের ৬ দফার রূপরেখাও রহিয়াছে।
দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরাইয়া আনার প্রশ্নটির অবতারণা করিয়া শেখ মুজিব বলেন যে, শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে সফল করার পূর্বসত। সংগ্রামকে সঠিক পথে পরিচালনার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করিয়া তিনি বলেন যে, সংগ্রাম হইবে দুর্বার হইতে দুর্বারতর। সে সংগ্রামও পরিচালনায় মুহুর্তের জন্য যেমন বিরতির সুযোগ নাই, ঠিক তেমনি মুহূর্তের জন্য উচ্ছৃঙ্খলতার প্রশ্রয় দেওয়ারও কোন অবকাশ নাই।
হ্রস্ব বক্তৃতার উপসংহারে দেশবাসীকে তিনি আশ্বাস দিয়া বলেন যে, সংগ্রামী বীর যাঁরা মুক্তি সংগ্রামে আত্মাহুতি দিয়াছেন আমরা তাঁদের রুধির ধারাকে ব্যর্থ হইতে দিব না। প্রয়োজনবোধে আমার নিজের রক্ত দিয়া বিগতকালের সংগ্রামী রক্তের সাফল্যকে চিরন্তন ও চিরজাগরূক রাখিব।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, শেখ সাহেবের বাসভবনের বাহিরে এবং চতুর্দিকের রাস্তায় তিল ধারণের ঠাঁইটুকুও ছিল না। কেবল মানুষ আর মানুষের ঢেউ আসিয়া যেন আছড়াইয়া পড়িতেছিল। তাঁর বাসভবনের সম্মুখবর্তী সড়কে, আর লেকের পাড়ে। পাঁচ-দশ মিনিট পর পরই গাড়ী বারান্দায় আসিয়া তাঁহাকে দেখা দিতে হইতেছিল আগ্রহী জনতার সাথে।

সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!