You dont have javascript enabled! Please enable it!

শরণার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় বরাদ্দ মঞ্জুরির বিলের
আলােচনায় লােকসভায়দ শরথ দেবের ভাষণ

গত ৯ আগস্ট বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দের উপর আনীত বিলের আলােচনায় সংসদ সদস্য দশরথ দেব বলেন, বাংলাদেশ আগত শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য যে অতিরিক্ত বরাদ্দের বিল আনা হয়েছে আমি তা সমর্থন করে কয়েকটি রাজ্যের বিশেষ করে আমার রাজ্যের রিলিফ ও পুনর্বাসন বিভাগের কয়েকটি কাজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
তার পূর্বে আমি এ সম্পর্কে গত ৪ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত বিবৃতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যেটা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, শরণার্থীরা ভারতের অতিথি এবং সে জন্য আমাদের মাত্র কয়েক মাসের জন্য তাদের সাহায্য-সহায়তা করতে হবে। আমি বুঝতে পারছি না তিনি কীভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌছালেন। তিনি কি মনে করেন ইয়াহিয়া খান কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হবেন, অথবা তিনি কি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চান যাতে ইয়াহিয়া সন্তুষ্ট হয় এমন কোনাে রাজনৈতিক সমাধানের কথা? এটা তিনিই একমাত্র বলতে পারেন। আমি জানি না তিনি কী উত্তর দেবেন। কিন্তু আমি মনে করি এটা শুধু আত্মসন্তুষ্টি। এই লড়াই অবশ্যই দীর্ঘস্থায়ী লড়াই হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কী করে বলতে পারলেন আর মাত্র কয়েকমাস শরণার্থীদের সাহায্য-সহায়তা করতে হবে? বাংলাদেশের বর্তমান সংগ্রাম হলাে সেই সংগ্রাম যার ফলশ্রতি হিসেবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ বিশ্বের দরবারে আত্মপ্রকাশ করবে। সুতরাং সমস্ত মুক্তিকামী জনগণের সক্রিয় সমর্থন মুক্তি সংগ্রামীদের কাম্য। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তারা আন্তরিকতার সাথে সেরূপ সমর্থন পাচ্ছেন না। আনন্দের বিষয় হলাে ভারত সরকার শরণার্থীদের কিছু সাহায্য দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলাে ভারত সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং তাদের সরকারের মাধ্যমে মুক্তি সংগ্রামীদের সর্বপ্রকার সাহায্য দেওয়া।
বাংলাদেশ মুক্ত না হলে এবং ইয়াহিয়া সরকারকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করতে না পারলে শরণার্থী সমস্যার কোনাে সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সুতরাং আমাদের পক্ষ থেকে শরণার্থীদেরকে যেমন সাহায্য দেওয়া দরকার তেমনি মুক্তি সংগ্রামীদেরও সর্বপ্রকার সাহায্য দেওয়ার কাজই প্রয়ােজন।
আমরা এখানে শরণার্থীদের জন্য আরাে ২০০ কোটি অতিরিক্ত বরাদ্দের বিষয় নিয়ে আলােচনা করছি কিন্তু বর্তমানে ভারতে আগত শরণার্থীদের বিশেষ করে ত্রিপুরার বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় প্রাপ্ত শরণার্থীদের বর্তমান অবস্থার প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সরকার বলছেন শরণার্থীদের দৈনিক মাথাপিছু ১.১ হারে রেশন দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমি বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে দেখেছি আসলে তারা ৭২ পয়সার বেশি রেশন পাচ্ছেন না। অত্যন্ত নিম্নমানের জিনিসপত্র তাদের দেওয়া হচ্ছে।
প্রতিটি শরণার্থী শিবিরে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলছে। কিছু খারাপ প্রকৃতির লােক টাকা লুটে খাচ্ছে। আমি জানি না কখন এই সমস্ত শিবির পরিচালকরা শরণার্থীদের প্রতি সহৃদয় হবেন।
আমার রাজ্যে যে সমস্ত শরণার্থীরা আছেন তাদের তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় ১২ লক্ষ শরণার্থীর মধ্যে মাত্র ৫ লক্ষ শিবিরে স্থান পেয়েছেন। বাকিরা কেউবা নিজের ব্যবস্থা করে থাকছেন এবং বহু সংখ্যক আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন যাপন করছেন। মাত্র ২৪ হাজার শরণার্থীকে অন্যত্র সরানাে হয়েছে।
যে ত্রিপুরা রাজ্যের লােকসংখ্যা ছিল মাত্র ৫ লক্ষ ইতিপূর্বে আরাে ১১ লক্ষ শরণার্থী আসার ফলে ১৯৭১ সালে লােকসংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ লক্ষ। বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী আগমনের ফলে বর্তমানে প্রতিটি লােকের অনুপাতে ৩ জন করে শরণার্থী ঘাড়ে চেপেছে। ত্রিপুরা বর্তমানে শরণার্থী অধ্যুষিত রাজ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বর্তমানে ত্রিপুরার সঙ্কট জর্জরিত অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে অবিলম্বে বেশি সংখ্যক শরণার্থীকে অন্যত্র সরাতে হবে এবং শিবিরে আশ্রয় প্রাপ্ত শরণার্থীদের নির্দিষ্ট হারে রেশন দিতে হবে।
ত্রিপুরায় দৈনন্দিন একটার পর একটা সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে। ত্রিপুরার সীমান্ত অঞ্চলে পাক-বাহিনীর গুলি বর্ষণের ফলে প্রতিদিন ২/৩ জন ভারতীয় নাগরিক নিহত হচ্ছেন। গত ৭ আগস্ট সােনামুড়া শহরে গুলি বর্ষণের ফলে ৫ জন ভারতীয় নাগরিক নিহত হয়েছেন। গতকালও আগরতলা শহরােপকণ্ঠে মাইন বিস্ফোরণের ফলে তিনজন বিএসএফ আহত হয়েছেন। সীমান্ত অঞ্চলের নাগরিকরা নিরাপত্তার অভাবে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলে যাচ্ছেন সরকারের উচিত অবিলম্বে ঐ সমস্ত অঞ্চলের নাগরিকদের পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।
বাংলাদেশের বিভিন্ন চা বাগান থেকে ইতিমধ্যে ২ লক্ষ শ্রমিক ত্রিপুরায় প্রবেশ করেছেন। তারা কোনাে শিবিরে আশ্রয় না পেয়ে অনাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা যেখানে দৈনিক ৩.৪ টাকা করে। মজুরি পেতেন আজকে সেখানে তারা ১ টাকা মজুরিতে কাজ করতে রাজি হচ্ছেন। যার ফলে ত্রিপুরার চা শ্রমিকদের মধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে। অথচ যেহেতু ওরা রেশন পাচ্ছে না সেহেতু তাদের আমরা কাজ করতে বাধা দিতেও পারবাে না। সুতরাং আমি আশা করবাে শরণার্থী সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের ক্ষেত্রে সরকার এই সমস্ত শ্রমিকদের ব্যাপারে সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন।
এই অতিরিক্ত মজুরির বিল পূর্ণ সমর্থন করে আমি দাবি জানাচ্ছি এই সাহায্য শরণার্থীদের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করতে হবে এবং শরণার্থীদের উপযুক্ত রেশন দেওয়ার ব্যাপারে আমলাতান্ত্রিক মনােভাব বর্জন করতে হবে।

সূত্র: দেশের ডাক
২০ আগস্ট, ১৯৭১
০৩ ভাদ্র, ১৩৭৮

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!