রণাঙ্গন থেকে
(নিজস্ব প্রতিনিধি প্রেরিত সংবাদ) ময়মনসিংহ জেলার অষ্টগ্রাম থানায় এখন পর্যাপ্ত জঙ্গীশাহীর সেনাবাহিনীর লােকেরা প্রবেশ করতে পারে নাই বলিয়া জানা গিয়াছে। ময়মনসিংহ জেলা ন্যাপের জনৈক নেতা জানাইয়াছেন যে, উক্ত থানা এলাকার জনগণের ঐক্য এবং দৃঢ় মনােবল প্রতিক্রিয়াশীলদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করিয়া দিয়া দুর্বত্ত সৈন্যদের এবং দুষ্কৃতকারীদের সকল প্রকার কার্যকলাপ অর্থাৎ লুঠতরাজ প্রভৃতি হইতে উক্ত এলাকাকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হইয়াছে। এই এলাকার ন্যাপ, আওয়ামীলীগ কমিউনিস্ট, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ ও সকল স্বাধীনতাকামী জনগণের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত সংগ্রাম পরিষদ বিভিন্নভাবে কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করিয়া শত্রু যাতায়াত পথ বিনষ্ট করিয়া দিয়াছে। তাহাদের প্রচেষ্টায় এই থানায় এখনও কোনও রাজাকার বা বদর বাহিনীর লােক মাথা চাড়া দিয়া উঠতে পারে নাই। উপরন্তু পার্শ্ববর্তী থানা কুমিল্লা জেলার নাসের নগরের কোন এক ইউনিয়নের দুই জন রাজাকার অস্ত্রসহ ‘তাহাদের নিকট আত্মসমর্পণ। করিয়াছে। এই থানার যুবকদের সমন্বয়ে স্থানীয়ভাবে একটি মুক্তিবাহিনী গড়িয়া উঠিয়েছে। এই বাহিনীতে যােগদান করার জন্য বিভিন্ন এলাকা হইতে প্রতিদিন বহু ছাত্র, যুবক ভিড় জমাইতেছে। এই অঞ্চলে গড়িয়া উঠা মুক্তিবাহিনী ঢাকা জেলার সাথেও যােগাযােগ রাখিয়া বিভিন্ন অপারেশন চালাইয়া যাইতেছে। যতই দিন যাইতেছে মুক্তি বাহিনীর ক্রিয়াকলাপ বৃদ্ধি পাইতেছে, জনগণের মধ্যে মুক্তি বাহিনীর প্রতি আস্থা দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছে। অপরদিকে সর্বত্র দস্যু সেনারা মুক্তি বাহিনীর কাছে দারুণ মার খাইয়া মনােবল হারাইয়া দুর্বল হইতেছে। ‘ স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর পরই এই অঞ্চলে জনগণকে সংগঠিত করার জন্য এবং শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে জনগণের সহায়তায় একটি গণ আদালত গড়িয়া ভােলা হয়। সংগ্রাম পরিষদের লােকেরা সার্থকভাবেই এই অঞ্চলে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখিতে ও জনগণের মনােবল দৃঢ় রাখতে সক্ষম হয়। যাতায়াত ব্যবস্থা অচল হইয়া পড়ায় জিনিস পত্রের দাম কিছুটা বৃদ্ধি পাইলেও তাহা জনগনের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে নাই। অট্টগ্রাম থানা এলাকায় প্রবেশ করিতে না পারিয়া ইয়াহিয়ার সৈন্যরা মারমুখী হইয়া পার্শ্ববর্তী থানার বিভিন্ন অঞ্চলে নির্মম অত্যাচার, উৎপীড়ন, বাড়ি ঘরে অগ্নি সংযােগ, নারী ধর্ষণ, যুবকদের ধরিয়া রক্ত বাহির করিয়া নিয়া হত্যা করিয়া ফেলিতেছে।
ইহাতেই জনগণের মনােবল নষ্ট করা তাহাদের পক্ষে সম্ভব হইতেছে না। সবত্রই অভিভাবকরা ছেলেদের মুক্তিবাহিনীতে যােগদান করার জন্য প্রেরণ করিতেছেন। হুসেনুর পাকুন্দিয়া এলাকায় মুক্তি বাহিনীর অভিযানের ফলে জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি হইয়াছে। ইতিমধ্যে সদর মহকুমার শ্যামগঞ্জ এলাকায় মুক্তি বাহিনী এক অভিযান চালাইয়া রাজাকারদের কাছ হইতে দুইটি রাইফেল হস্তগত করিয়াছে, গৌরীপুর, পুর্বল, দুর্গাপুর, কলমকান্দি, রাহাট্টা, নেত্রকোণা, কিশােরগঞ্জ, বাজিতপুর, ভৈরব, ভালুকা, ত্রিশাল, ফুলবাড়িয়া প্রভৃতি অঞ্চলে মুক্তি বাহিনী অভিযান চালাইয়া বহু পাক সেনাকে হতাহত করিয়াছে এবং যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করিতে সক্ষম হইয়াছে। যতদিন যাইতেছে জনগণ উপলব্ধি করিতে পারিতেছে যে, স্বাধীনতা সংগ্রাম নবায়ত হইবে এবং সকল দল ও মতের ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়ােজনীয়তাও তাহারা অনুভব করিতেছে। জনগণের মধ্যে ব্যাপক রাজনৈতিক প্রচারের মাধ্যমে মনােবল দৃঢ় রাখা এবং সংগঠিত ও সুপরিকল্পিত মুক্তি যুদ্ধ পরিচালনা। অপরিহার্য বলিয়া বিভিন্ন মহল হইতে তাগিদ পাওয়া যাইতেছে। মুক্তিযােদ্ধাদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করিয়া তােলার প্রয়ােজনীয়তাও তাহারা অনুভব করিতেছে। পাবনা। বাঙলাদেশ মুক্তিবাহিনীর পক্ষ হইতে পাবনা জিলার বিভিন্ন অঞ্চলে দখলকারী পাক-সেনাকে বিপর্যস্ত করার কাজ তীব্রতর হইয়াছে। একই সঙ্গে চলিতেছে দালাল জামাতে ইসলামী ও মুসলিম লীগপন্থীদের নিধনকার্য । ফলে জিলার সর্বত্র দালাল ও পাক সেনাদের মধ্যে দারুণ ত্রাসের সঞ্চার হয়েছে।
খবরে জানা গিয়াছে, এ যাবৎ সাতবাড়িয়ার কুখ্যাত দালাল জামাত কর্মী টেগর খান (যাহার চক্রান্তে বিগত জুন মাসে সাতবাড়িয়াতে এক দিনে দেড় সহস্রাধিক নিরীহ নরনারী পাক সেনার। আক্রমণে নিহত হন), দাশুরিয়ার মুসলিম লীগপন্থী মওলানা আতাউর রহমান, সুজা নগরের ডঃ ফজলুর রহমান, পাবনা শহরের কুখ্যাত জামাতে ইসলামীর গুন্ডা লােকমান নিকারী ও তাহার দুই পুত্র, পাবনা। শহরের অন্যতম জামাতপন্থী হাজী মনসুর আলী বিশ্বাস, শাহাজাদপুরের জামাতে ইসলামীর মওলানা ওসমান গণি সহ প্রায় ৩০ জন দালাল নিহত হইয়াছে। ফলে গ্রামাঞ্চলের বেশ কিছু সংখ্যক দালাল ভীত সন্ত্রস্ত হইয়া শহরে নিরাপদ আশ্রয়ে আস্তানা লইতে বাধ্য হইয়াছে। বিগত ১০ই অগস্ট পাবনা শহরের নিকটবর্তী শিঙ্গ শ্মশানঘাটের সন্নিকটস্থ বৈদুতিক লাইনের স্তম্ভটি। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা বাহিনী উড়াইয়া দিয়াছে। ফলে সিরাজগঞ্জ পাবনা বিদ্যুৎ যােগাযােগ বেশ কয়েকদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে। এই খবর লেখা পর্যন্ত শহরে স্বাভাবিক বিদ্যুৎ চালু না হওয়ার ফলে শহরের খুব নিচু ভল্টেজে আলাে জ্বলিতেছে। বিগত ১৪ই অগস্ট মুক্তিযুদ্ধের গেরিলাবাহিনী রাইবেলায় চাটমােহার থানা আক্রমণ করিলে থানাস্থ অফিসাররা পালাইয়া যায়। তবে থানা অফিসের বহু জিনিসপত্রের ক্ষতি সাধিত হইয়াছে এবং থানা প্রহরারত তিন জন রাজাকার নিহত হইয়াছে।
কাকডাঙ্গা গ্রামে পাক ফৌজের ব্যাংকারের উপর মর্টারের গােলাবর্ষণ ও মুক্তিবাহিনীর সরাসরি আক্রমণের ফলে ৭ জন পাক সেনা খতম হয়। খুলনার কলারােয়া থানার বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিফৌজ বহু সংখ্যক সেতু ধ্বংস করিয়া পাক হানাদার বাহিনীর চলাচল অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছে। গত ৫ই সেপ্টেম্বর গেরিলা বাহিনী রাজাকারদের ঘাটির উপর আক্রমণ চালাইয়া ৪ জনকে হত্যা করে এবং দুটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল উদ্ধার করে। এই অঞ্চলে সম্প্রতি পাঁচ জন রাজাকার অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করিয়াছে। অন্যান্য রণাঙ্গনে। প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, রণাঙ্গনে প্রতিদিনই শত্রুপক্ষের ক্ষয়ক্ষতি বাড়িয়া চলিয়াছে। গেরিলা যুদ্ধ সকল সেক্টরেই তীব্রতর হইতেছে। গত ১০, ১১ ও ১২ই সেপ্টেম্বর এই তিন দিনে বাঙলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে গেরিলাদের হাতে শতাধিক শত্রুসৈন্য নিহত হইয়াছে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ১১ই ও ১২ই সেপ্টেম্বর পঁচাগড় বাজার ও রানীশঙ্কাইলে শত্রুসেনাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালাইয়া অনেককে হতাহত করে।
মুক্তিযুদ্ধ। ১ : ১১
১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯