You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.16 | বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে নয়া মুক্তাঞ্চল সিলেট অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ তীব্রতর হচ্ছে - সংগ্রামের নোটবুক

বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে নয়া মুক্তাঞ্চল সিলেট অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ তীব্রতর হচ্ছে। গ্রামে গ্রামে বর্গীদের হত্যা, লুণ্ঠন আর নির্যাতন।

(স্টাফ রিপাের্টার) সিলেট ১৪ সেপ্টেম্বর-বাংলাদেশের বীর গেরিলা যােদ্ধারা হানাদার বাহিনীর উপর ক্রমাগত জোর আক্রমণ চালিয়ে সিলেট জেলার একহাজার বর্গ মাইলেরও অধিক এলাকা শক্রকবল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে নিয়েছেন। সমগ্র মুক্ত এলাকায় এখন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। মুক্তিবাহিনী এসব মুক্তাঞ্চলে সামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তােলার চেষ্টা করেছেন।সিলেট জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আমাদের সংবাদদাতারা জানিয়েছেন যে, এই জেলার গােলাপগঞ্জ, মৌলভী বাজার, বিয়ানী বাজার, সুনামগঞ্জ, ছাতক, হবিগঞ্জ, বড়লেখা প্রভৃতি এলাকায় প্রায় সহস্রাধিক বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখন সম্পূর্ণরূপে মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রাধীন রয়েছে। এ ছাড়া আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে দিয়ে মেশিনগান, রাইফেল, শটগান, স্টেনগান প্রভৃতিসহ তাদের আড়াই শতাধিক আগ্নেয়াস্ত্র এবং বিপুল পরিমাণ গােলাবারুদ দখল করে নেয়। গোলাপগঞ্জ থেকে বড়লেখা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত গােলাপগঞ্জ মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে খানসেনাদের ২৪ ঘন্টা ব্যাপী ব্যাপক সংঘর্ষে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি ৫৫ জন খান সেনা নিহত ও অপর ৬৫ জন আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে গােলাপগঞ্জের কুতুবউদ্দিন ও আব্দুল মান্নান নামক দুজন শহীদ হন এবং অপর একজন (খুশী) গুরুতররূপে আহত হয়। মুক্তিবাহিনী ঐদিন বড়লেখা পর্যন্ত নিজেদের নিরস্ত্রণাধীনে আনেন। মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করার দায়ে প্রসঙ্গত উল্লেখযোেগ্য যে, ইতিপূর্বে এই এলাকার কয়েকজন বাস ড্রাইভার গােপনে কয়েকজন। মুক্তিযােদ্ধাকে গােলাপগঞ্জ শহরে নিয়ে যায়।

ফলে শহরে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। পরে শান্তিকমিটির গােয়েন্দারা এবং গােবিন্দশ্রী গ্রামের রফিক মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযােগে লালমিয়া ও মােস্তফা মিয়া নামক দুজন বাস চালককে খানসেনাদের হাতে সােপর্দ করে। সেই থেকে উক্ত বাস ড্রাইভারদের আর কোন খবর পাওয়া যায় নি। আট গ্রাম থেকে খানসেনাদের পলায়ন মুক্তিযােদ্ধাদের জোর গেরিলা তৎপরতায় অতিষ্ঠ হয়ে আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে খানসেনারা আট গ্রাম এলাকা থেকে তল্পিতল্পা গুটোতে বাধ্য হয়। জঙ্গীসেনারা এই এলাকাকে এতই নিরাপদ মনে করে যে, তাদের স্থানীয় দোসরদেরও অজ্ঞাতে তারা উক্ত এলাকা থেকে পালিয়ে যায়। লাতুতে খান সেনারা অবরুদ্ধ মুক্তিবাহিনী সম্প্রতি লাতু এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁধ ডিনামাইট বিস্ফোরণে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেয়। ফলে হানাদার বাহিনীর একটি দল এখানে সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।

মুক্তিবাহিনীর বীর যােদ্ধারা সম্প্রতি লক্ষীবাজার (ভারতীয় করিমগঞ্জ থানার লক্ষী বাজার নয়) এলাকার তেলিখালে বাঁধ এবং রহিমপুর খালের বাঁধ দুটিকে মাইন বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেন। তারা জুলাইর সেতুটিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীনে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। ৫০ জন সাধারণ নাগরিকের কোন খবর নেই আগস্ট মাসের ২য় সপ্তাহে বিয়ানী বাজার, জকিগঞ্জ ও গােলাপগঞ্জ এলাকা থেকে পাক-সেনারা ৫৬ জন। শান্তিপ্রিয় নাগরিককে ধরে নিয়ে যায়। কয়েক দিন পরে এদের মধ্যে কয়েকজনকে মারধাের করে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাকী ৫০ জনের ভাগ্যে কী ঘটেছে, উক্ত ৬ জনের কেউই তা বলতে পারে না। জনগণের ধারণা, তাদেরকে নিশ্চয়ই মেরে ফেলা হয়েছে। পল্লীগ্রামে বিমান হামলা সুনামগঞ্জ এলাকায় মুক্তিবাহিনীর হাতে পাক-দস্যুরা বিপুলসংখ্যায় নিহত হতে থাকলে এখানকার বিভিন্ন পল্লীগ্রামের উপর বিমান হামলা চালানাে হয়। হানাদার বাহিনীর বিমান থেকে ব্যাপক বােমা ও মর্টার মেশিনগানের গুলীবর্ষণ করে। ফলে বহু সাধারণ মানুষ হতাহত হয় এবং তাদের বাড়ীঘর ধ্বংস হয়ে। যায়। ফলে এই এলাকার হাজার হাজার অসহায় মানুষ ভারতে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

ভাঙ্গা এলাকায় ৬ জন খানসেনা খতম ভারতীয় সীমান্তের নিকটবর্তী ভাঙ্গা এলাকায় আগস্ট মাসের শেষের দিকে হানাদারবাহিনীর সাথে। মুক্তিযােদ্ধাদের এক সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষের ফলে ৬ জন দস্যুসেনা খতম হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে একজন নিহত এবং বাবুল নামে অপর একজন আহত হয়। এই ঘটনার দু’দিন পরে খানসেনাদের এক অতর্কিত হামলায় ৭৬জন মুক্তিসেনা আহত হন। মুক্তিযােদ্ধারা তখন রাতের টহল শেষে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে নিজেদের ক্যাম্পে ফিরছিলেন। জনৈক ব্রিটিশ নাগরিক নিহত আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে বালাগঞ্জ থানাধীন খাদিমপুর গ্রামের রাজাকার বাহিনীর লােকেরা জনৈক বৃটিশ নাগরিককে গুলী করে হত্যা করে। সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার পরও রাজাকাররা এই বিদেশী আপদটিকে পৃথিবী থেকে না সরিয়ে ছাড়ল না। যুক্তফ্রন্ট বাজারে ২৫০ জন খানসেনা খতম সিলেট জেলার জুরি থানাধীন যুক্তফ্রন্ট বাজারস্থ পাকসেনাদের একটি ছাউনির উপর মুক্তিবাহিনী আগস্ট মাসের প্রথম দিকে এক দুঃসাহসিক অভিযান চালায়। রাতের অন্ধকারে পরিচালিত এই অতর্কিত আক্রমণে কমপক্ষে ২৫০ জন খানসেনা নিহত হয়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযােগ্য যে পাকসেনাদের স্থানীয় কুখ্যাত জামাত-ই-ইসলামীর দালাল মনু মিয়া। মহাজন তথাপি তার অপকর্ম অব্যাহত রেখেছে। টাল সামলাতে বিমান হামলা। সুনামগঞ্জ স্কুলের সামরিক ছাউনির উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে মুক্তিবাহিনী সম্প্রতি ৮ জন শত্রু। সেনাকে ঘায়েল করে। 

মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে খানসেনারা টাল সামলাতে অপারগ হয়ে উঠলে পাক বিমানবাহিনী আকাশ থেকে বােমাবর্ষণ ও মর্টার মেসিনগান থেকে গুলীবর্ষণ করে। ধীরাই এলাকায় মুক্তিবাহিনী ১৬টি নৌযান দখল করেছে সম্প্রতি ধীরাই এলাকায় মুক্তিবাহিনী পরপর কয়েকদিন হামলা চালিয়ে খানসেনাদের রসদবাহী ১৬টি লঞ্চ ও স্টিমার দখল করে নিয়েছে। | এইসব নৌযান থেকে মুক্তিযােদ্ধারা ২০০ বস্তা সিমেন্ট ও কয়েক শত বস্তা চিনি এবং আটা ও ময়দা উদ্ধার করে। চারজন খানসেনাসহ ১টি ষ্টিমার ঘায়েল। আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে মুক্তিযােদ্ধাদের এক হামলার ফলে ৪ জন খানসেনাসহ একটি রসদবাহী স্টিমার ঘায়েল হয়েছে। শান্তি কমিটির সভায় খানসেনাদের হামলা জগন্নাথপুর থানার শিরামিশি গ্রামে আগস্ট মাসের শেষের দিকে শান্তি কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয় । সভায় বহুসংখ্যক খানসেনা উপস্থিত ছিল। কিন্তু খানসেনারা খেয়ালের বশে সভায় যােগদানকারীদের উপর চড়াও হয় এবং গুলীবর্ষণ করতে থাকে। ঘটনাস্থলে বহুসংখ্যক নাগরিক নিহত হয়। খানসেনারা এই এলাকা থেকে সরে গেলে ঘটনাস্থলেই ৪৫টি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। জনসাধারণের অনুমান, বর্বরদের এই হামলায় কমপক্ষে ৬০ ব্যক্তি খুন হয়েছে।

সাপ্তাহিক বাংলা : ১:১ এ

১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯ –সাপ্তাহিক বাংলা