You dont have javascript enabled! Please enable it!

নয়া-হারমাদদের বিরুদ্ধে পটুয়াখালীর জীবন-মরণ লড়াই

(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক) নদীমালা-বিধৌত, সমুদ্রমেখলা পটুয়াখালির নিম-প্রকৃতির সহিত লড়াই-করিয়া-বাঁচা মানুষ বর্তমানে  এক নূতন ধরনের জীবন-মরণ লড়াইয়ে নিয়ােজিত। এই লড়াই অন্ধ নিষ্ঠুর প্রকৃতির বিরুদ্ধে নয়।  তাহাদের পূর্বপুরষ একদা পর্তুগীজ হারমাদদের বিরুদ্ধে জীবন, সম্পদ ও সম্রম রক্ষার যে-লড়াই করিয়াছিল অনেকটা সেই ধরনের। তবে এই নূতন হারমাদরা আরও বেশি নৃশংস, আরও বেশি রক্ত  পিপাসু। ইহাদের লক্ষ্য শুধু লুণ্টন বা নরহত্যা নয়, ইহারা বাঙলাকে ঔপনিবেশিক ধরনের শােষণেরউদ্দেশ্যে চিরদিনের মত পদানত রাখিতে চায়, বাঙলাদেশের জনগণকে রাখিতে চায় গােলাম বানাইয়া । পটুয়াখালী জেলা ২৫শে মার্চের পর দীর্ঘদিন মুক্ত ছিল। প্রকৃতপক্ষে পটুয়াখালীতে পাকবাহিনী | প্রবেশ করে সর্বশেষে। মে মাসের প্রথমদিকে পাক হানাদাররা জিলা শহর দখল করার পর পুটয়াখালীর মুক্তিসংগ্রামীদের সহিত যােগাযােগ দুরুহ হইয়া পড়ে। সম্প্রতি আমাদের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন এলাকা হইতে যে সংবাদ জানাইয়াছেন উহা সংক্ষেপে নিম্নরূপ।  পটুয়াখালীর গলচিপা, বাউফল, খেপুপাড়া, আমতলা প্রভৃতি থানায় আওয়ামী লীগ, ন্যাপ,  কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য সংগ্রামী শক্তির ঐক্যবদ্ধ পরিচালনায় মুক্তিফৌজ সংগঠিত হইয়াছে এবং | মুক্তিফৌজ এই সকল এলাকায় দালাল ও রাজাকার বাহিনী নিধন করিয়া মুক্ত এলাকা গড়িয়া তুলিয়াছে। পটুয়াখালী জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর জোর তৎপরতা চলিতেছে। মুক্তি বাহিনীর সাথে গ্রামের কৃষক জনসাধারণের সহযােগিতা ক্রমেই অধিকতর সক্রিয় ও সংগঠিত রূপ নিতেছে।

গত ২৫শে। জুলাই খেপুপাড়া বন্দরের নিকটবর্তী সেনালা গ্রামে গ্রামের জনসাধারণ একজোট হইয়া অতর্কিতে বাড়ি ঘেরাও করিয়া দুই জন রাজাকারকে ধরিয়া ফেলে এবং উত্তম মধ্যম দিতে দিতেই ঐ দুইটিকে শেষ করিয়া ফেলে। আমতলী থানার কুখ্যাত দালাল শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আলাউদিন একটি লঞ্চে মুক্তি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। মুক্তি বাহিনী তাহার কাছে পাক সরকারের দেওয়া একটি রিভলভার পাইয়াছে। আমাদের পটুয়াখালীর প্রতিনিধি জানাইতেছেন যে, খেপুপাড়া, ধনেখালি, বড়বাইশদিয়া, রাংগাবালি, পানপট্টি, গলাচিপা, বাউফল, আমতলী ও বরগুনার প্রতিটি গ্রামে মুক্তি বাহিনী তৎপর। এই সকল এলাকায় কোন রাজাকার নাই। রাজাকার, শান্তি কমিটির মাতব্বর ও দালালদের খতম ও বিতাড়িত করিয়া মুক্তি বাহিনী এই সব অঞ্চলে উহাদের সংগঠিত লুটতরাজ একেবারে ঠান্ডা করিয়া দিয়াছে। ইয়াহিয়ার এই সব ঘৃণিত অনুচরেরা এখন জিলা সদরে গিয়া আশ্রয় নিয়াছে।  দালালদের সহায়তায় এইসব অঞ্চলে পাকিস্তানী হানাদার দস্যুরা ব্যাপক লুটতরাজ, হত্যা, অগ্নি সংযােগ ও নারী নির্যাতন চালায়। পাকসেনাদের ছত্রছায়ায় মুসলিম লীগের দালাল ও সমাজবিরােধী গুন্ডা বদমাইশদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহারা অবস্থাপন্ন কৃষকদের ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন ও হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ঘরের মেয়েদের অপহরণ ও নির্যাতন চালায়। পাক সেনাদের ঘাটিতে ইহারা নারী ও মদ সরবরাহ করে। গলাচিপা থানায় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন, দেলােয়ার, মধু, রাজা, ডাউকা প্রভৃতি পরিচিত গুন্ডাদের সংগঠিত করিয়া থানা-পুলিশের সহায়তায় সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি লুট করিয়াছে। লুটের সময় মন্টুরায়ের ৮০ বৎসর বয়স্কা বৃদ্ধ মাতাও এই সব পিশাচদের অত্যাচারের হাত হইতে রক্ষা পায় নাই । গুন্ডারা রাইফেলের আঘাতে এই বৃদ্ধার দেহ হইতে রক্ত ঝরাইয়াছে।

এই বৃদ্ধার অপরাধ, ইহার সাতটি সন্তান সকলেই উচ্চশিক্ষিত কিম্বা ছাত্র। | এই নির্যাতনের মধ্যে মুক্তি বাহিনীর তৎপরতা বিস্তার লাভ করিতে থাকে ও জনগণের প্রতিরােধ ক্রমেই প্রবল হইতে প্রবলতর হয়। আমাদের প্রতিনিধি জানাইতেছেন, মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যােদ্ধারা  বাউফল থানার কুখ্যাত দুই দালাল অজেদ আলী সুফী ও সাত্তার মােল্লাকে খতম করিয়াছে। এই দুই রত্ন কালিজুরী বন্দরে জনগণের লক্ষ লক্ষ টাকার ধন সম্পত্তি লুণ্ঠন করিয়াছে। বন্দরের বিখ্যাত ব্যবসায়ী। মাধাই পাশের বাড়ীতে অগ্নি সংযােগ করিয়া তাহার দুই কন্যাকে অপহরণ করিয়াছে। মুক্তিবাহিনী। অজেদ আলী সুফিকে গুলি করিয়া হত্যা করে। সাত্তার মােল্লা প্রথমে পালাইয়া তাহার ধনী শ্বশুর বাড়িতে আশ্রয় লয়। মুক্তিবাহিনী সেখান হইতে তাহাকে ধরিয়া আনিয়া প্রকাশ্য জনসমক্ষে একটি খেজুর গাছের সাথে বাঁধে এবং গুলি করিয়া হত্যা করিয়া তাহার লুঠ ও নারীহরণের সাধ মিটাইয়া দেয়। | আমাদের বাখরগঞ্জ সংবাদদাতা জানাইয়াছেন যে, পেয়ারপুরে লঞ্চঘাটে একটি লঞ্চে আক্রমণ চালাইয়া মুক্তিবাহিনী ৪ জন পাক সেনাকে খতম করিয়াছে। ঐ পথে লঞ্চ চলাচলই এখন বন্ধ হইয়া গিয়াছে। গত ৬ই অগস্ট বরিশাল-ভুরঘাটা পাকা সড়কে ‘হল্লা নামক স্থানের গুরুত্বপূর্ণ ব্রীজটি মুক্তিবাহিনী। ডিনামাইট দিয়া উড়াইয়া দিয়াছে। ভুরঘাটা হইতে মাদারীপুর ও ফরিদপুরের মধ্যবর্তী ৪টি সড়ক সেতু মুক্তিবাহিনী উড়াইয়া দিয়াছে। মােস্তফাপুরে এক আচমকা আক্রমণে মুক্তি বাহিনীর গেরিলারা ৫ জন রাজাকার ও ২ জন পুলিসকে হত্যা করিয়াছে।  গত ২৮শে অগস্ট গৌরনদীর পাক দালাল হাবিব তাহার ৪ জন সাকরেদ সহ মুক্তিবাহিনীর হাতে খতম হইয়াছে। মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান তৎপরতায় পটুয়াখালীর জনগণের মনােবল বহুগুণে বাড়িয়া গিয়াছে ও তাহারা সক্রিয় প্রতিরােধ গড়িয়া তুলিতেছেন। জনসাধারণ এখন শত্রুর অনুচরদের মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরাইয়া দিতেছেন। দালাল বাহিনী ও পাক সরকারের প্রশাসন এই সমস্ত অঞ্চলে অচল। জনগণ খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করিয়া দিয়াছেন। কোন কোন থানার দারােগী পুলিস থানার অস্ত্রশস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনীতে যােগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করিতেছে । তবে ইহাদের আন্তরিকতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ না হইয়া মুক্তিবাহিনী ইহাদের গ্রহণ করিতেছে না।

মুক্তিযুদ্ধ :: ১০৪

১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯ –মুক্তিযুদ্ধ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!