রংপুরের চিঠি
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক) রংপুর জিলার বিভিন্ন এলাকা হইতে আমাদের সংবাদদাতাগণ জানাইতেছেন ? কুড়িগ্রাম মহকুমার ফুলবাড়ি থানা বাঙলাদেশের মুক্তি বাহিনীর দখলে। এই থানা এলাকার জন সাধারণ ব্যাপকভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। প্রায় প্রতি পরিবারেই ২১ জন যুবক মুক্তিবাহিনীতে যােগ দিয়া যুদ্ধরত আছেন। এখনও সুস্থদেহী যুবক এমন কি প্রৌঢ়গণও দলে দলে শিক্ষা-শিবিরে যােগ দিতেছেন। ঐ থানায় বাঙলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু রহিয়াছে। উল্লেখযােগ্য যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু হইতেই এই এলাকায় সকল গণতান্ত্রিক শক্তি তথা আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র লীগ, ছাত্র ইউনিয়ন সমন্বয়ে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং এখনও তা অক্ষুন্ন আছে। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং এখনও তা অক্ষুন্ন আছে। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে এলাকার সমস্ত সুস্থদেহী যুবকদের সংগঠিত করিয়া সামরিক ও রাজনৈতিক শিক্ষা দেওয়া হইতে থাকে। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে সংগঠিত গণবাহিনী ও মুক্তি বাহিনী। সাফল্যের সঙ্গে ধরলা নদী বরাবর প্রতিরক্ষা লাইন স্থাপন করিয়া সার্থকভাবে লালমণিরহাট হইতে পরিচালিত পাক সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করিতে থাকেন। এই এলাকার জনগণের অদম্য চেষ্টায় সামরিক তৎপরতা শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও পুরাদমে চালু রহিয়াছে। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে বিভেদ সৃষ্টির সকল অপচেষ্টাও জনগণ প্রতিহত করিয়া চলিয়াছেন। এই এলাকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক অধিকৃত এলাকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় জনসাধারণ অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছেন। অবিলম্বে এই মুক্ত এলাকায় সকল প্রশাসনিক বিভাগের সমন্বয় সাধন প্রয়ােজন ও বাঙলাদেশ সরকারের তরফ হইতে এই এলাকার দুঃস্থ জনগণের জন্য খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসা সাহায্য প্রদানের ব্যবস্থা করা বিশেষ প্রয়ােজন।
বিশেষতঃ মুক্তি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের পরিবারবর্গের জন্য সাহায্য প্রদানের ব্যবস্থা একান্ত জরুরী। অবিলম্বে সাহায্যাদি প্রদান ও বেসামরিক প্রশাসন ও মুক্তি বাহিনীর কাজের সুষ্ঠু সমন্বয় সাধনপূর্বক আদর্শ প্রশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্টার দাবিতে বাঙলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পক্ষে একটি প্রতিনিধিদল উত্তরাঞ্চলের আঞ্চলিক প্রশাসনিক কর্মকর্তার সহিত সাক্ষাৎ করেন। তিনি অবিলম্বে মুক্তাঞ্চলে সাহায্য, পুনর্বাসন ও বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস প্রদান করিয়াছেন। পাক সেনা ধৃত লালমণিরহাট থানার টোগরাই হাট অঞ্চলে জনৈক পাক সেনা গ্রামবাসীর হাতে ধরা পড়ে। প্রকাশ, জনৈক পাক সেনা মহিলার ছদ্মবেশে জনৈক গ্রামবাসীর গৃহে প্রবেশ করে। তার ছদ্মবেশ প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামবাসীরা সমবেতভাবে তাহাকে ধরিয়া ফেলে। উক্ত পাক সেনার সাহায্যকারী ৩ জন রাজাকার প্রাণভয়ে পালাইয়া যায়। ঐ সৈন্যটি মুক্তি বাহিনীর হেফাজতে আছে। | সম্প্রতি ভুরুংগামারী থানার এক যুদ্ধে মুক্তি বাহিনী হাতাহাতি লড়াইয়ে বেশ কয়েকজন পাক সেনাকে খতম করে। প্রকাশ, মুক্তি বাহিনী অতর্কিত গেরিলা কায়দায় ৭০ জন পাকসেনার একটি দলকে ঘেরাও করিয়া ফেলে ও হাতবােমা ও বেয়নেট দ্বারা আক্রমণ চালাইয়া গােটা দলটিকে খতম করে।
ডিমলা সম্প্রতি নিলফামারী মহকুমার ডিমলা থানার শটীবাড়ি ও ছাতনাই গ্রামে হানাদার পাক সেনা ও একটি দল বাঙলাদেশের মুক্তি বাহিনীর বিপুল আক্রমণে ধ্বংস হয়। আক্রমণে ঘটনাস্থলেই রাজাকার সহ ১৭ জন পাক সৈন্য খতম হয়। মুক্তি বাহিনী আরাে ৮ জন পাক সৈন্যকে গ্রেফতার করিয়া উত্তর বঙ্গের মুক্ত এলাকা হাতিবান্ধায় লইয়া আসেন। উক্ত ঘটনার পর পাক সৈন্যরা মরিয়া হাইয়া শটিবাড়ি ও ছাতনাই গ্রামের উপর অকথ্য নির্যাতন চালাইয়া অসংখ্য মানুষ হত্যা করে এবং গ্রাম দুইটি সম্পূর্ণরূপে জ্বালাইয়া পােড়াইয়া ধ্বংস করিয়া দেয়। কিন্তু এই অত্যাচার সত্ত্বেও উক্ত এলাকার স্বাধীনতাকামী বীর জনগণ না দমিয়ে আরাে সংগঠিতভাবে দলে দলে মুক্তি যুদ্ধে যােগাদান করিতেছেন।
রাজাকারের আত্মসমর্পন সম্প্রতি নিলফামারী মহকুমার চিলাহাটি এলাকায় শত্রুবাহিনীর উপর মুক্তি বাহিনীর আক্রমণ আরও জোরদার হইয়াছে। এই আক্রমণের ফলে অত্র এলাকায় পাক সেনাদের মনােবল ভাঙিয়া পড়িতেছে। জানা গিয়াছে যে, চিলাহাটীতে দুই জন রাজাকার পাক সৈন্যদের উপর বেপরােয়া গুলি বর্ষণ করে এবং ফলে অনেক পাক সৈন্য হতাহত হয়। পরে উক্ত দুই জন রাজাকার অস্ত্র-শস্ত্র সহ মুক্তি বাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণ করে। এখানে উল্লেখযােগ্য যে, বাঙলাদেশের গ্রামে গ্রামে হানাদার বাহিনী জামাত মুসলিম লীগ ছাড়া স্বাধীনতাকামী জনগণকেও যে জোর পূর্বক রাজাকার বাহিনীতে যােগ দানে বাধ্য করিতেছে। তাহাই এই সব ঘটনা হইতে পরিষ্কার হইয়া উঠিতেছে। | কিছুদিন পূর্বে ডােমার থানার মীরজাগঞ্জ এলাকায় পাক সেনারা কয়েকজন রাজাকারকে সঙ্গে লইয়া গ্রামে লুটতরাজের জন্য বাহির হয়। কিন্তু পথে উক্ত রাজাকারেরা পাক সেনাদের কয়েকহাত পিছনে পিছনে হাঁটিতে থাকিলে হঠাৎ পাক সেনারা পিছন ফিরিয়া তাকায় ও বলে, “শালা লােক ভাগতা হায়” এবং সঙ্গে সঙ্গেই বেপরােয়া গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই উক্ত রাজাকারেরা মৃত্যু বরণ করে। এই ঘটনা নিকটস্থ কর্মরত কৃষকরা দেখিয়া সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের নিকট খবর পাঠায়। ন্যাপ নেতা শহীদ বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেল, নওগাঁর বিশিষ্ট ন্যাপ নেতা এড়ভােকেট আব্দুল জব্বার সরদার ইয়াহিয়ার রাজাকার গুন্ডাদের হাতে নৃশংশভাবে নিহত হইয়াছেন। রংপুরের গ্রামাঞ্চলে রাজাকার বাহিনীতে যােগদান না করিলে যুবকদের গ্রেপ্তারের হুমকি দেওয়া হইতেছে। কিন্তু বাঙলার বীর মাতাগণ তাঁদের সন্তানদের মুক্তিবাহিনীতে যােগ দেওয়ার জন্য। পাঠাইতেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ ।১; ১০
১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯ –মুক্তিযুদ্ধ