You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.04 | রণাঙ্গনের খবর সাংবাদিক - সংগ্রামের নোটবুক

রণাঙ্গনের খবর

সাংবাদিক

চট্টগ্রামে কার্ফ গত ১৬ই আগস্ট মুক্তিবাহিনী চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্রবাহী কতগুলি শত্রু জাহাজ ডুবাইয়া দেওয়ার পর পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম বন্দরে ও কর্ণফুলি নদীতে কষ্ণুি জারী করিয়াছে। জানা গিয়াছে মুক্তিবাহিনীর সহিত বালুচ সৈন্যদের যােগসাজস রহিয়াছে বলিয়া পাঞ্জাবী সৈন্যরা সন্দেহ করে এবং গেরিলা আক্রমণের সময় বন্দরে প্রহরারত সকল সান্ত্রী ও বেলুচ সৈন্যদের গ্রেপ্তার করে। এই ঘটনার পর চট্টগ্রাম বন্দরে পাঞ্জাবী ও বালুচ সৈন্যদের মধ্যে এক সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে একজন মেজর, একজন ক্যাপ্টেন ও একজন লেফটেন্যান্ট সহ ২৩ জন পাক সৈন্য নিহত হয়। এই ঘটনা সম্পর্কে তদন্তের জন্য ঘাতক টিক্কা খান তড়িৎ চট্টগ্রাম বন্দরে ধাবিত হয়। রাজধানীর উপকণ্ঠে। গত সপ্তাহে মুক্তি বাহিনীর বীর গেরিলারা বাঙলাদেশের আশেপাশে জোর তৎপরতা চালাইয়াছে। সােনারগাও, বৈদ্যের বাজার, আনন্দ বাজার ইত্যাদি এলাকার মুক্তাঞ্চলে স্বাধীন বাঙলাদেশের পতাকা  উড়িতেছে। মুক্তি বাহিনী এই এলাকার দুই জন কুকাত পাক দালাল—জামপুর ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান জয়নাল কাজী ও বৈদ্যের বাজার ইউনিয়নের দালাল মান্নান মােল্লাকে হত্যা করিয়াছে। ঢাকার নিকটস্থ ডেমরা শিল্পাঞ্চলে গেরিলা মুক্তিযােদ্ধারা গত সপ্তাহে ২০ জন রাজাকারকে খতম এবং ৭টি ৩০৩ রাইফেল ও পাঁচটি দেশী নৌকা দখল করিয়াছে। খতমের তালিকায় রুই কাতলা মুক্তি বাহিনীর হাতে নিহত পাক হানাদার দস্যুদের তালিকায় কয়েক জন পদস্থ অফিসারের নাম সংযােজিত হইয়াছে। ইহারা আবার পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় সামরিক ও অসামরিক কর্মকর্তাদের আপনজন। লেঃ জেনারেল আজহারের পুত্র ক্যাপ্টেন সরােয়ার কুমিল্লা রণাঙ্গনে নিহত হইয়াছেন।

সরকারের গােয়েন্দা দপ্তরের অধিকর্তা রিজভির জামাতা ক্যাপ্টেন ওমর আব্বাস ময়মনসিংহ রণাঙ্গনে, নৌবাহিনীর কমােড়র কামাল খানের ভাই মেজর আজিম কামাল খান টাঙ্গাইলে ও লেঃ জেনারেল বিজার জামাতা ক্যাপ্টেন হাসেম খান সিলেট রণাঙ্গনে খতম হইয়াছেন। জলপথে গেরিলা তৎপরতা। বাঙলাদেশের শক্রকবলিত এলাকার অভ্যন্তরীণ জলপথে মুক্তি বাহিনীর গেরিলা তৎপরতা ক্রমশঃই বৃদ্ধি পাইতেছে। গত সপ্তাহে মেশিনগান ও মর্টার সজ্জিত ছয়টি যন্ত্রচালিত নৌকায় পাক বাহিনী সিলেটের টাকেরগাঁও ও লালপুরে আক্রমণ চালায়। মুক্তি বাহিনী ইহার মধ্যে একটি নৌকা ডুবাইয়া দেয় ও কয়েক জন শত্রু সেনাকে হতাহত করে। রংপুরের চিলমারিতে দুইটি পাক ফৌজী নৌকা ডুবাইয়া দেয় ও একটি মােটরলঞ্চ অকেজো করিয়া দেয়।  মুক্তি বাহিনীর গেরিলা তৎপরতা দমনের জন্য পাক বাহিনী রাজশাহী, পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলার পদ্মা ও অন্যান্য নদীতে নৌকা চলাচলই নিষিদ্ধ করিয়া এক ফরমান জারী করিয়াছে বলিয়া খবর পাওয়া গিয়াছে। বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তি বাহিনী সূত্রে জানা গিয়াছে, গত ২০শে অগস্ট হইতে ২৫শে অগস্টের মধ্যে বাঙলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণে দুই জন সামরিক অফিসার সহ চার শতাধিক শত্রু সৈন্য ও প্রায় চল্লিশজন রাজাকার নিহত হইয়াছে। এই সময়ে ৫ জন শত্রু সৈন্য মুক্তি বাহিনীর হাতে ধরা পড়িয়াছে। গেরিলারা এই সময়ের মধ্যে শত্রুবাহিনীর ৯টি যান, ৪টি সড়ক সেতু, ২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ২টি স্পীড় বােট, ২টি গানবােট ও শত্রুদের ব্যবহৃত ২টি দেশী নৌকা ধ্বংস করিয়াছে। গেরিলারা ৭টি রাইফেল, ১টি মেশিন গান, ৮টি বন্দুক ও ৮টি দেশী নৌকা হস্তগত করিয়াছে। গত ২৫শে অগস্ট রঙপুর জেলার ডিমলা থানায় সটিবাড়ী গ্রামে পাক বাহিনীর একটি ঘাটি মুক্তি বাহিনী দখল করিয়া নিয়াছে। এই ঘাটি দখলের সংঘর্ষে ১০ জন পাক সেনা খতম এবং ১১ জন রাজাকার ও ৮ জন পাক দালাল মুক্তি বাহিনীর হাতে ধরা পড়িয়াছে। মুক্তিবাহিনী ৭টি রাইফেল ও প্রচুর গােলাবারুদ হস্তগত করিয়াছে। এই সংঘর্ষে ৪ জন মুক্তি সেনানী আহত হইয়াছেন।

গত ২৪শে অগস্ট কুমিল্লার শালতা নদী ও মন্দাভাগে গেরিলাদের অতর্কিত আক্রমণে ২৫ জন। পাক সৈন্য নিহত হইয়াছে।আদমজীতে তৎপরতা মুক্তি যােদ্ধারা গত ২রা অগস্ট সাব-স্টেশনের উপর সাফল্যজনক গ্রেনেড আক্রমণ চালাইয়া স্টেশনটি সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করিয়া দেয়। গত ৩রা অগস্ট মুক্তি বাহিনীর যােদ্ধারা নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত ৮টি পাটের গুদামে অগ্নি সংযােগ করে এবং ৮টি গুদামই সাফল্যজনকভাবে বিধ্বস্ত করিয়া দেয়। আগুন আয়ত্তে আনার জন্য দমকল বাহিনী এবং সামরিক বাহিনী ঘটনা স্থলের দিকে অগ্রসর হইলে মুক্তি বাহিনীর প্রবল প্রতিরােধের সম্মুখীন হয় এবং ঘটনাস্থল ত্যাগ করিতে বাধ্য হয়। এর পর মুক্তি বাহিনী জালুয়াপাড়া সেতুটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করিয়া দেয় এবং ঢাকার সাথে এই অঞ্চলের সমস্ত যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করিয়া দেয়। মুক্তি বাহিনী এই অঞ্চলের মােট তিনটি বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন ধ্বংস করে এবং জুট মার্কেটিং কর্পোরেশনের জেটিতে ডিনামাইট আক্রমণ চালাইয়া একটি ফ্ল্যাট ডুবাইয়া দেয়। বর্তমানে বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে এই অঞ্চলের সমস্ত মিলের কাজ বন্ধ হইয়া গিয়াছে। অগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মুক্তি বাহিনী নারায়ণগঞ্জ ডক ইয়ার্ডের উপর এক আক্রমণ চালাইয়া বহু সংখ্যাক স্পীড বােট ধ্বংস করিয়া দেয়। মুক্তি বাহিনী চিত্তরঞ্জন কটন মিলের বিপরীত দিকে অবস্থিত ডক ইয়ার্ডের উপর আক্রমণ চালাইয়া অপর একটি ফ্ল্যাট ডুবাইয়া দেয়।

মুক্তিযুদ্ধ। ১ : ৯ ৮

৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯ –মুক্তিযুদ্ধ