পশ্চিম পাকিস্তানেও অসন্তোষের চাপা আগুন জ্বলছে পার্বত্য অঞ্চলে ২০ হাজার যুবক গেরিলা ট্রেনিং নিচ্ছে
|(বিশেষ প্রতিনিধি)। বাঙলাদেশের আকাশে বাতাসে ইয়াহিয়ার নিজ হাতে লাগানাে যে দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলছে তার লেলিহান শিখা পশ্চিম পাকিস্তানের উষারমরুতেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। গণধিকৃত পাক জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণও প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠছে। পত্রান্তরে প্রকাশিত এক খবরে প্রকাশ, পশ্চিম পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টি ন্যাপ’ সহ অন্যান্য প্রগতিশীল শক্তি বাংলাদেশে পাক জঙ্গীশাহীর গণহত্যার ও নৃশংস নির্যাতনের তীব্র নিন্দা ও সমালােচনা করেছে। সিন্ধুর কমিউনিষ্ট পার্টি প্রচারিত এক প্রচার পত্রে বাঙলাদেশে গণহত্যার অপরাধে ইয়াহিয়া খানের গ্রেফতার ও বিচারের দাবী জানিয়েছে। সংবাদ পত্রের উপর সরকারী কড়া নিয়ন্ত্রণ থাকার পত্রপত্রিকায় এসব খবর স্থান পায় না।
জঙ্গীশাহীর বাঙলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন না করার পশ্চিম পাকিস্তানে, বিশেষ করে বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধুতে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ, সাধারণ সম্পাদক সংগ্রামী বেলুচ নেতা মীর গাউস বখৃশ বেজেক্সো, সিন্ধুর প্রখ্যাত জননেতা জি, এম, সৈয়দ, কবি শেখ আয়াজ ও বালুচ ছাত্র সংস্থার সভাপতি নাসির খান সহ আরাে বহু বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দকে অন্তরীণ অথবা গ্রেফতার করা হয়েছে। বেলুচিস্তানের আর একজন ন্যাপ নেতা আখতার খান বন্ধুর বাড়ী থেকে ফিরার পথে অজ্ঞাতনামা আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। সরকারী মহল এই হত্যাকান্ডকে ব্যক্তিগত শত্রুতা’ বলে পাশ কাটাবার চেষ্টা করলেও লাহােরের একটি বিখ্যাত সংবাদপত্রের মতে উহা একটি রাজনৈতিক হত্যাকান্ড । রেডিও পাকিস্তানের এক খবরে প্রকাশ, সারা পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ’) সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানীকে ৭৮ নং সামরিক বিধিবলে সম্প্রতি করাচী থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযােগ্য যে, বাঙলাদেশের মত পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষুদ্র প্রদেশগুলি (বেলুচিস্তান। সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধু) ও জাতি সমূহ পাকিস্তানের জঙ্গী একনায়কত্ববাদী শাসকগােষ্ঠী দ্বারা গত চব্বিশ বছর ধরে চরম ভাবে শােষিত ও নির্যাতিত হয়েছে। বেলুচীরা অতীতে পাক শাসকগােষ্ঠির বিরুদ্ধে দীর্ঘ। তিন বছর স্বাধীনতার দাবীতে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করেছে। সীমান্ত প্রদেশের পাঠানরাও ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খানের পিতা অগ্নি পুরুষ খান আবদুল গাফফার খানের নেতৃত্বে এক ইউনিট’ বরাধী ও পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে বহুদিন ধরে লড়াই করেছেসহ্য করতে হয়েছে সীমাহীন নির্যাতন ও অত্যাচার। সিন্ধুর জনসাধারণ ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন করে অনুরূপ কষ্ট বরণ। করেছে।
এই অঞ্চলে গফফার খান ও ন্যাপের নেতৃত্বে যে দুর্বার আন্দোলন শুরু হয় তা দমনের জন্য পাকিস্তানী জঙ্গীশাসকরা যেরূপ বৰ্ব্বর ও ঘৃণ্য পন্থা গ্রহণ করেছিল, তা’ অকল্পনীয়। সীমান্ত প্রদেশের জনসাধারণের প্রায় ৭০ কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। হাজার পাঠানকে কারারুদ্ধ করে। তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানাে হয়। চর সাদ্দা নামক স্থানে গাফফার খানের অনুগামী হাজার। হাজার পাঠান নরনারীরা সমবেত হয়ে মসজিদে বন্দী পাঠানদের কল্যাণে প্রার্থনা করার সময়ে চতুর্দিক। থেকে মেশিনগান চালিয়ে হাজার হাজার নরনারীকে হত্যা করা হয়েছে। ঐ স্থানে পাঠান নারীরা শিশু কোলে এবং মাথায় পবিত্র কোরাণ শরীফ নিয়ে এসেছিলেন। পবিত্র কোরাণগুলি তথাকথিত ইসলামিক রাষ্ট্রের বর্বর সৈনিকদের গুলীতে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়। বেলুচিস্তানে ঈদের নামাজ পড়ার সময় ঈদের ময়দানে পাক বিমান থেকে বােমাবর্ষণ করে ও মেসিনগান চালিয়ে হাজার হাজার বেলুচীকে হত্যা করা হয়েছে। চারশতাধিক বিলুচীকে কারারুদ্ধ করে তাদের পায়ে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে ইলেক্ট্রক শক দিয়ে নির্যাতন চালিয়ে অনেককে হত্যা করা হয়। সতের জন বেলুচী নেতাকে ফাঁসী কাষ্ঠে ঝুলানাে হয়। জিন্দাখানা বন্দীশিবিরে প্রায় ৩০০০ পাঠানকে বছরের পর বছর কারাগারে বন্দী রেখে চরম নির্যাতন চালান হয়। সিন্দুতেও চরম নির্যাতন চালান হয়েছে। গত ‘৬৬ সালে আইয়ুবের নির্বাচনের সময় আইয়ুবকে ভােট দেয়নি বলে সন্দেহে শত শত সিন্ধীদের বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং নিরীহ জনতার উপর ঘােড়া চালিয়ে নির্যাতন চালিয়েছে। বলা বাহুল্য, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান সহ পশ্চিম পাকিস্তানে মূলত ন্যাপ’-এর নেতৃত্বে এই আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে চলেছে। দীর্ঘ ২৪ বছর পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠির দ্বারা বাংলাদেশ, বেলুচিস্তান সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধুর জনগণ একইভাবে নির্যাতিত, বঞ্চিত ও শােষিত হয়েছে।
পাকিস্তান পরিণত হয়েছে পাঞ্জাবী স্থানে। উপরন্ত ইয়াহিয়ার নির্বিচার গণহত্যায় সিন্ধীরা আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। নিজেদের বিগত দিনের এবং সাম্প্রতিক কালে বাঙলাদেশের রক্তাক্ত ইতিহাস তাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে দেশী-বিদেশী একচেটিয়া পুজিবাদী ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের পৃষ্ঠপােষকতায় পাকিস্তানের পাঞ্চাবী জঙ্গীশাসকরা এখনাে ইসলামের নামেই এত কিছু করে যাচ্ছে। আসলে আরাে ব্যাপকতাকে শশাষণের স্বার্থেই তারা ইসলাম’ শব্দটিকে এমনভাবে অপব্যবহার করছে, ধর্মকে রক্ষার জন্য নয়। শুধুমাত্র ধর্মকে ভিত্তি করে যে কোন রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না তার চাক্ষুস প্রমাণ তথাকথিত ‘পাকিস্তান। ইসলামিক প্রজাতন্ত্র (!)’। পাকিস্তান আজ ভাঙনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে এবং এই ভাঙন শুধু মাত্র পূর্বাঞ্চল থেকেই নয়—পাঠান-বেলুচ অধ্যুষিত পশ্চিমাঞ্চলেও সমান। এ ভাঙন রােধের সাধ্য জঙ্গীশাহীর। নেই।—পাকজঙ্গীশাহী বাঙলাদেশে বিশ্বের নজির বিহীন নরহত্যা চালিয়েছে এবং এখনাে চালিয়ে । যাচ্ছে, যার ফলে প্রায় এক কোটি বাঙালী প্রতিবেশী ভারতে প্রাণভয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে—এই । ঘটনায় পশ্চিমের শােষিত বঞ্চিত ও নির্যাতিত পাঠান বেলুচ ও সিন্ধীরা বুঝেছে যে, শুধু মিষ্টি কথায় চিড়ে ভিজবেনা। তাই নিজেরাও রাজনৈতিকভাবে, সংগঠিত হচ্ছে দিকে দিকে চলছে গোপন প্রস্তুতি। পশ্চিম পাকিস্তানের মেহনতী ও নির্যাতিত জনগণের সমর্থন ইয়াহিয়াশাহী পায়নি বরং পেয়েছে ধিক্কার। ও তিক্ত সমালােচনা। তারা জানে যে, পাকিস্তানী জঙ্গী শাসকগােষ্ঠি শুধুমাত্র বাঙালীদেরই। নয়—তাদেরও সমান শত্রু।
খবরে প্রকাশ, অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমােডর জানজুরার নেতৃত্বে লন্ডস্থ পশ্চিম পাকিস্তানীরা। বাঙলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থনে একটি কমিটি গঠন করেছেন এবং ইয়াহিয়া গােষ্ঠিকে উৎখাত করে। পশ্চিম পাকিস্তানে গণতন্ত্র, সকল জাতির জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়েছেন। কাবুলে স্বেচ্ছা নির্যাসিত পাঠান নেতা খান আবদুল গাফফার খান বাঙলাদেশের নির্মম হত্যাযজ্ঞের জন্য পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকগােষ্ঠির তীব্র নিন্দা ও সমালােচনা করেছেন। তার এক ভারতীয় বন্ধুকে। লিখিত এক পত্রে মন্তব্য করেছেনঃ ‘পাকিস্তান একটি বেয়াড়া ছেলে, চড় না খেলে শায়েস্তা হবে না।’ বাঙলাদেশের নরহত্যা সম্পর্কে বলেন, পাকিস্তান বা ইসলাম রক্ষার জন্য নয়, নিছক ক্ষমতা রক্ষার উদ্দেশ্য এ নরহত্যা চালান হয়েছে।’ তিনি আরাে বলেন, বাঙলাদেশের একমাত্র অপরাধ, নির্বাচনে। তারা জয়লাভ করেছে।’ বাঙলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ কিছুদিন আগে এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে আত্রাই মর্মে দৃঢ় আশা প্রকাশ করেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের। নিপীড়িত জাতিসমূহ (বেলুচ পাঠান ও সিন্ধী) বাংলাদেশের সংগ্রামের সমর্থনে এগিয়ে আসবে। কারণ বাঙলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের সাফল্যের সঙ্গে তাদের গণতন্ত্র ও জাতীয় অধিকার আদায়ের। আন্দোলনের ভবিষ্যত জড়িত বলে তিনি মন্তব্য করে। এদিকে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (‘ন্যাপ’) সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী খান লন্ডন। থেকে ফিরে সম্প্রতি কাবুলে মন্তব্য করেছেন ও সামরিক শক্তি দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের পক্ষে। বাঙলাদেশ দখলে রাখা অসম্ভব।’ বাঙলাদেশের গণহত্যায় তিনি বেদনা প্রকাশ করে বলেন, ‘পাকিস্তান। অবশ্যই টুকরাে টুকরাে হয়ে থাকে।’ বর্তমানে তিনি তাঁর পিতা গাফফার খানের সঙ্গে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে অবস্থান করেছেন। বলা বাহুল্য পাকিস্তানের বৈরীদেশ বলে কথিত আফগানিস্তানে। সীমানা সংলগ্ন বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে বিগত নির্বাচনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। (ন্যাপ) বিপুল ভােটাধিক্যে জয়লাভ করেছে।
অপর দিকে বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া এক খবরে জানা গেছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশের পার্বত্য অঞ্চলে বিশ হাজার যুবক গােপনে গেরিলা ট্রেনিং গ্রহণ করছে। | বাঙলাদেশে দেশী-বিদেশী মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় ইয়াহিয়া জঙ্গীশাহী নিজ হাতে যে আগুন জ্বালিয়েছে—সে আগুন আজ পশ্চিম পাকিস্তানেও ছড়িয়ে পড়ছে। এই সর্বগ্রাসী আগুন নিভাবার। আশায় পশ্চিম পাকিস্তানী বামপন্থী প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের কারারুদ্ধ করে অবস্থা শান্ত করার চেষ্টা করলেও তা হবে বরং আগুনে আরাে ঘি ঢালারই নামান্তর। অন্যের ঘর জ্বালাতে গেলে নিজেরাই ঘর জ্বলে—এই দেয়ালের লিখন ইয়াহিয়া খন্ডন করবেন কিভাবে?
বাঙলাদেশ । ১ :
২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯ –বাঙলাদেশ