You dont have javascript enabled! Please enable it!

রণাঙ্গন থেকে লিখছি

এইতাে একটু আগেই সূর্য ডুবেছে। সমস্ত পশ্চিম আকাশটায় এখনও লেগে রয়েছে রক্তিম আভা। ক্লান্ত পাখীরা একটু আগেও আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে ফিরে যাচ্ছিলাে নীড়ে। এখন আর নেই। অন্ধকারটা একটু একটু করে করে জমাট বাঁধছে। দু’একটা কালাে পেঁচা কিংবা বাদুড়ের ডানার ঝটপটানি শুনতে পাচ্ছি মাঝে মাঝে । আমরা সবাই নীরব। তিনটে নৌকোয় করে ছােট্ট একটা খাল ধরে এগুচ্ছিলাম। বৈঠার সাথে জলের আঘাতের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ একটানা বেজে চলেছে কানে। | বুকের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা অনুভব করছি। সমর অভিযানে বেরিয়েছে পঁয়তাল্লিশ জন। মুক্তিযােদ্ধার দল। ফরিদপুর জেলার মােকাসেদপুর থানা অভিযানে বেরিয়েছে মুক্তিযােদ্ধারা। স্থানীয় পুলিশ-বাহিনীর সাহায্যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করতে ব্যর্থ হয়ে জঙ্গীশাহী সেনাবাহিনী এবং রাজাকার নিয়ােগ করেছে থানায়। মুক্তিবাহিনীর দফতরে সেই খবর পৌছনাের সঙ্গে সঙ্গে থানা অভিযানে বেরিয়েছে মুক্তিযােদ্ধার দল। একটানা প্রায় দু’মাইল খালপথে অতিক্রম করার পর নৌকো ভিড়লাে। একটা বরুণা গাছের নীচে। আমরা নামলাম । মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে রাইফেল, লাইট মেশিনগান আর গ্রেনেড।

আবার পায়ে হাঁটা পথ। পথ ঠিক নয় ধানক্ষেত্রের আলপথ ধরে এগুচ্ছি। আবছা অন্ধকারে পথ চলতে একটু অসুবিধে হচ্ছে আমার। কিন্তু দ্রুত নিঃশব্দ পদসঞ্চারে এগিয়ে চলেছে ওরা। শত্রু নিধনের জন্য। নির্ভল পথ অতিক্রম। নির্ভর নিঃশঙ্ক চিত্ত। দৃপ্ত শপথে পাসানের দৃঢ়তা ওদের মনে। | দু’ পাশের ক্ষেত্রের ধানগাছগুলাে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত বেড়ে উঠেছে। ছােট্ট একটা ডােবা, পাশ দিয়ে। চলতে গিয়ে অনেক পুরনাে অনেক চেনা একটা গন্ধ নাকে লাগলাে। না, শুধু মাটির গন্ধ নয় । পাট পচতে দেয়া হয়েছে তারই গন্ধ। পাট। বাংলাদেশের সােনালী আঁশ। বাংলার মানুষের অর্থনীতির মেরুদন্ড এই পাট। এর মূল্য কোনদিন পায়নি। কৃষককুল। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যে সােনালী সম্পদ সৃষ্টি করে বাংলার মানুষ তার ন্যায্য মূল্য কোনদিনই পায়নি। ভাবতে গিয়ে একটু যেন উন্মনা হয়ে পড়েছি। এই তাে আমার দেশ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শুধু শােষণ আর বঞ্চনাই পেয়েছে আমার দেশের মানুষ। তার পর কোন যাদুকাঠির পরশে জেগে উঠেছে সেই দেশ—সে দেশের মানুষ। 

ভীম বিক্রমে জেগে উঠেছে ঘােষণা করেছে এই আমার দেশ, এই আমার মাটি, এই তাে আমার জীবন। তােমরা চলে যাও। বিদেশী বেনিয়া শােষকের দল দূর হও । অনেক নিয়ে রক্ত এবার শোধর পালা । হয় চলে যাও না হয় রক্ত দিয়ে, শােধ জীবন দিয়ে করতে হবে ঋণ। অন্যমনস্ক ভাবে পথ চলতে চলতে কখন জানিনা পৌছে গেছি লক্ষ্যস্থলে। একজন মুক্তিযােদ্ধা শক্ত হাতে আমায় ধরে না ফেললে হয়তাে থানার মধ্যে একেবারে শত্রুর সামনে গিয়েই পড়তাম।  বেশ খানিকটা দূরে থামতে হলাে। তবু এখান থেকেও দেখতে পাচ্ছি থানার বারান্দায় আর পাশের ব্যারাকে পাকসেনা আর রাজাকারদের চলাফেরা। | ত্রি-মুখী আক্রমণ শুরু হলাে মুক্তিবাহিনীর। রাত সাড়ে আটটা এখন। মােকসেদপুরের নির্জনতাকে। ভেঙে চুড়মার করে দিয়ে গর্জন করছে মেশিনগান আর রাইফেল। সুরক্ষিত থানা আর ব্যরাকের মধ্যে থেকে পাকসেনা আর পুলিশও গুলি চালাচ্ছে। প্রাণভয়ে এলােপাথাড়ি গুলি চালাচ্ছে। বুঝতে পারছেনা কোন দিকে মুক্তি যােদ্ধা আছে। কতজন আছে। বেসামাল হয়ে পড়েছে পাকসেনারা। মাঝে মাঝে গুলি। ছােড়া বন্ধ করে নিজেদের প্রয়ােজনমত অবস্থান পরিবর্তন করছে মুক্তিযােদ্ধারা। এমনি স্থান পরিবর্তন পাকসেনাদের আরও দিশেহারা আরও বিপর্যস্ত করে তুলেছে। দু’একজন পাকসেনা অস্ত্র ফেলে দিয়ে ছুটে পালাবার চেষ্টা করতে গেল। কিন্তু না পালাবার পথ নেই। মুক্তিযােদ্ধাদের অব্যর্থ গুলি লক্ষভেদ করছে। বেশ কয়েকজন গুলি খেয়ে থানার মুক্ত অঙ্গনে পড়ে গেছে। আর্তনাদ করছে আঘাতের যন্ত্রণায় ।

সারারাত চলেছে গুলি বিনিময়। ক্লান্তিহীন, নিদ্রাহীন গুলির আর গ্রেনেডের আক্রমণ চালিয়ে গেছে মুক্তিযােদ্ধারা। সূর্যের আলােতে আজকের মােকসেদপুর জেগে উঠেছে। পথ এখনও রাত্রির মতই জনশুন্য হয়ে রয়েছে। আজকের মােকসেদপুরে মানুষের ঘুম ভেঙেছে পাখীর গান শুনে নয়। জীবনের আহ্বান শুনেছে তারা গুলির শব্দে। স্বাধীনতার তুৰ্য্যনাদের মত বেজেছে সে শব্দ তাদের কানে।।  দোয়েল আর পাপিয়ারা কোথায় চলে গেছে। ওরাতাে শান্তির গান শােনায়। আজকের মােসদপুরে শান্তি নেই। রনদামামা বেজেছে। গুলির শব্দে ভয় পেয়ে উড়ে চলে গেছে। মনে পড়ছিলাে বাংলার মাটিতে অনাবিল শান্তির গান গাইতাে দোয়েল পাপিয়া। তারা কোথায় গেল । | এবার পাকসেনাদের গুলিছােড়া বন্ধ হয়েছে। না রনক্লান্তি নয়। গুলি শেষ হয়ে গেছে। যুদ্ধের সাধ মিটে গেছে। শশাষকের স্বার্থ রক্ষায় সুদূর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসেছিলাে বাঙলার মাটিকে বাঙালীর রক্তে ভিজিয়ে দিতে কিন্তু তার দাঁতভাঙা জবাব পেলাে। মােকসেদপুর থানায় উড়লাে স্বাধীন বাংলার পতাকা। বাঙালীরন আশা আকাঙ্ক্ষাকে বুকে নিয়ে মােকসেদপুরের নীল আকাশের নীচে উডীন হলাে বাঙালীর সম্মান। এগার ঘণ্টার দীর্ঘ যুদ্ধে দশজন পাকসেনা, আঠারজন বেইমান পুলিশ আর দুজন দালাল গুপ্তচর নিহত হয়েছে। মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে। থানাতেই থাকতত দু’জন। গুপ্তচরের কাজ করতাে। জানিয়ে দিত মুক্তিযােদ্ধাদের গতিবিধি । সুমচিত শিক্ষা পেয়েছে বিশ্বাসঘাতকেরা। পাক সেনাদের পরিত্যাক্ত রাইফেল আর মেশিনগান ইত্যাদি নিয়ে ফিরে চলেছে মুক্তিবাহিনী তাদের হেড কোয়ার্টাসে। গ্রামের মানুষ তখন বেড়িয়েছে পথে। মুখে তাদের মুক্তির আর সাফল্যের হাসি।

বাংলার মুখ ১ : ৪ ॥

৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯ –বাংলার মুখ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!