You dont have javascript enabled! Please enable it!

দুঃসাহসী মুক্তিবাহিনীর চমৎকার সাফল্য। বাঙলাদেশের বন্দরে মাত্র এক সপ্তাহে ডজনখানেক বিদেশী ও শত্রু জাহাজ নিমজ্জিত

(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক) স্থলভাগে ক্রমবর্ধমান গেরিলা তৎপরতায় হতচকিত হানাদার পাক সেনাদের বিরুদ্ধে বীর মুক্তি যােদ্ধাদের আক্রমণ এখন জলপথেও বিস্তার লাভ করিয়াছে। মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী গেরিলারা বাঙলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলের বিভিন্ন বন্দর ও জলপথে আক্রমণ চালাইয়া হানাদারদের সামরিক পরিবহন ও সরবরাহ ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করিয়া দিতেছে।

গত সপ্তাহে সবচেয়ে গৌরবােজ্জ্বল সাফল্য হইতেছে অনেকগুলি বিদেশী ও শত্রু জাহাজ ডুবাইয়া দেওয়া। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা অতর্কিতে আক্রমণ চালাইয়া বাঙলাদেশের বিভিন্ন বন্দরে বেশ কয়েকটি বিদেশী জাহাজসহ এক ডজনেরও অধিক জাহাজ ডুবাইয়া দিয়াছে। গত ১৬ই অগস্ট মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা মঙ্গলা বন্দরে আক্রমণ চালাইয়া ৬টি মালবাহী জাহাজ ডুবাইয়া দেয়। এই জাহাজগুলির মধ্যে দুইটি আমেরিকার, দুইটি চীনের, একটি জাপানের এবং একটি পাকিস্তানের। খবরে প্রকাশ, এই জাহাজগুলি পাক-বাহিনীর জন্য অস্ত্রশস্ত্র বহন করিতেছিল।  মাত্র সপ্তাহকালের মধ্যে এতগুলি বিদেশী ও শত্রু জাহাজ সাফল্যের সহিত ডুবাইয়া দেওয়ার ঘটনাটি দেশে-বিদেশে সর্বত্র আলােড়ন সৃষ্টি করিয়াছে। ডেইলী টেলিগ্রাফ’ ইহাকে অত্যন্ত চমৎকার সাফল্য’ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছে। ইহার মধ্যে দুঃসাহসী মুক্তিবাহিনীর দক্ষতার পরিচয় যেমন বিধৃত, তেমনি পাক শাসকচক্রের বিপদের আভাসও সুপরিস্ফুট। কারণ এই ঘটনার ফলে বিদেশী জাহাজ কোম্পানীগুলি পাক সামরিক চক্রের জন্য অস্ত্র-শস্ত্র বা রসদ বহন করা নিরাপদ মনে করিতেছে না।

১৬ই অগস্ট ‘লাইটনিং’ নামে একটি সােমালীয় জাহাজকেও মুক্তিবাহিনী ডুবাইয়া দিয়াছে। ১৫ই অগস্ট রাত্রে মুক্তিবাহিনী চট্টগ্রাম বন্দরে প্রচণ্ড আক্রমণ চালাইয়া ১০ কোটি টাকা মূল্যের পাকিস্তানী জাহাজ ‘আল-আব্বাস’কে ডুবাইয়া দিয়াছে। উল্লেখযােগ্য যে, ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন। সমর নায়ক আইয়ুব খান ১৫,০০০ টন মাল বহনক্ষম এই জাহাজটির উদ্বোধন করিয়াছিলেন ।  একই দিনে মুক্তিবাহিনী ফরমােজ নামক পাট বােঝাই অপর একটি জাহাজকেও নিমজ্জিত করিয়াছে। ইহা ছাড়াও মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা বিভিন্ন নদী-বন্দরে আক্রমণ চালাইয়া বেশ কিছু সংখ্যক মােটর লঞ্চ ও বার্জ ধ্বংস করিয়াছে। গত ১৫ই অগস্ট রাত্রে মুক্তিবাহিনী গম ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য বােঝাই একটি মালবাহী লঞ্চ, ৪টি মােটর টাগ, ১৬টি বার্জ এবং একটি মােটর লঞ্চ হস্তগত করিয়াছে। ইহা ছাড়াও পাক-বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত ৩০০০ মণ গম ও ২০০০ মণ চাল মুক্তিবাহিনী হস্তগত করিয়াছে। | মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণে ও বর্ষার ফলে অধিকৃত অঞ্চলের রেল ও সড়ক যােগাযােগ যখন একেবারে ছিন্নভিন্ন অবস্থা পাক দস্যুবাহিনীর তখন তাহাদের সাম্রাজ্যবাদী দোসরদের দেওয়া নৌযানের সাহায্যে জলপথের উপরই নির্ভর করিতেছিল। এই সময়ে জলপথে মুক্তিবাহিনীর সফল আক্রমণ। হানাদারদের দিশাহারা করিয়া তুলিয়াছে।

খুলনার বিস্তীর্ণ এলাকা শত্রুমুক্ত গত এক সপ্তাহে সিলেট, ময়মনসিং, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া, খুলনা ও নােয়াখালি অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পাইয়াছে। গত সপ্তাহের গােড়ার দিকে বসন্তপুর, কালিগঞ্জ, শ্যামনগর, মৌতলা, ঈশ্বরপুর, পাইকগাছা সহ খুলনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্তিবাহিনী হানাদারমুক্ত করিয়াছেন বলিয়া জানা গেল। এই সকল অঞ্চলের জনগণ মুক্তিবাহিনীর সহিত প্রত্যক্ষভাবে সহযােগিতা করিতেছেন।  আমাদের খুলনা প্রতিনিধি জানাইতেছেন যে, খুলনার তেরখাদা অঞ্চলে আক্রমণ চালাইয়া মুক্তিবাহিনী ২৬ জন রাজাকারকে হত্যা ও ৭ জনকে জখম করিয়াছে। গত সপ্তাহে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা যশোর সেক্টর যশাের চুয়াডাঙ্গা, যশাের-বেনাপােল সড়কে বেশ কিছু সেতু ও কালভার্ট ধ্বংস করিয়াছে। কুমিল্লায় ফকিরহাট ও কাসিমপুর রেলওয়ে স্টেশনের অনেকখানি রেলপথ মুক্তিবাহিনী ধ্বংস করিয়াছে।

কুষ্টিয়ায় গত ২২শে অগস্ট পাকসেনাদের ঘাটিতে অতর্কিত আক্রমণ করিয়া মুক্তিযােদ্ধারা কালাচাঁদপুরে ৬ জন ও জীবননগরে ৭ জন পাকসেনাকে খতম করিয়াছে। গত কয়েকদিনে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা তৎপরতায় বাঙলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে তিন জন অফিসার সহ ১৪৬ জন পাক সেনা নিহত এবং ৭৩ জন মারাত্মকভাবে আহত হইয়াছে। নির্ভরযােগ্য সূত্রে প্রকাশ যে, গত ৮ই অগস্ট মগলাহাটে পাঞ্জাবী বেলুচ সৈন্যদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে ৬৫ জন পাঞ্জাবী সৈন্য নিহত ও ৪৫ জন আহত হইয়াছে। অপরদিকে ১০ জন বেলুচ সৈন্য নিহত এবং ৬ জন আহত হইয়াছে।

মুক্তিযুদ্ধ। ১ : ৮

২৯ আগস্ট ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯ –মুক্তিযুদ্ধ

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!