You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.20 | মুক্তিবাহিনী শত্রুর উপর মরণ ছােবল হানছে - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিবাহিনী শত্রুর উপর মরণ ছােবল হানছে

বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর বীর যােদ্ধারা সফল আক্রমণ চালিয়ে বহু হানাদার শত্রুকে খতম করে। চলেছেন প্রতিদিন। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা এখন মরিয়া হয়ে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করছে। ভীত সন্ত্রস্ত পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনী দখলীকৃত এলাকার বহু জয়গা থেকে হটে যেতে বাধ্য হয়েছে। মুক্তি বাহিনীর দুঃসাহসী যােদ্ধারা গত ১১ই আগষ্ট ঢাকার বিলাসবহুল হােটেল ইন্টারকন্টিনান্টলে টাইম বােমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আমেরিকার টাইমস-এর সংবাদদাতাসহ ২০ জন শত্রু সৈন্যকে গুরুতরূপে আহত করে। শত্রু সৈন্য পরিবেষ্টিত দখলীকৃত ঢাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের নিত্তনৈমিত্তিক তৎপরতা দেখে বাঙালী বীর যােদ্ধাদের প্রশংসায় উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে সারা বিশ্বের স্বাধীনতা কামীরা।

অন্যদিকে গত ১৪ই আগষ্ট সিলেটের ডেপুটি কমিশনারের বাংলােতে পতপত করে উড়েছে আমাদের। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পতাকা। স্বাধীনতাকামীরা এমনি পতাকা উড়িয়ে দিয়েছেন সুনামগঞ্জের অনেকগুলাে বাসভবনের শীর্ষে। মুক্তিযােদ্ধারা রাজশাহীতে পাকিস্তানী নৌবাহিনীর একটি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছেন। ফলে অস্ত্রশস্ত্র – গােলা বারুদসহ বহু সংখ্যক দস্যু সৈন্য পদ্মা নদীতে ডুবে গেছে। এদিকে চট্টগ্রামের রামগড় মহকুমা হাকিমের দফতর গেরিলা যােদ্ধারা তছনচ করে দিয়েছেন। | সিলেট সেক্টরে মুক্তিবাহিনী গত ১২ ও ১৩ই আগষ্ট ১ শত ৪০ জন হানাদার সৈন্য খতম করেছেন। এর আগে মুক্তি যােদ্ধারা জুরি, কালীহাতি, কাংলি ও সবুজপুরে তৎপরতা চালান। মুক্তিবাহিনী পলায়নরত হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছেন। গত ৯ই আগষ্ট অত্র জেলার উত্তর-পূর্ব এলাকায় শাহবাজপুরে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যজনক আক্রমণে প্রায় ৫০ জন পাক সৈন্য খতম হয়েছে। গেরিলা যােদ্ধারা ৪ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে জীবন্ত অবস্থায় আটক করতে সক্ষম হয়েছেন। গত ৮ই আগষ্ট ঝিকরগাছার ধুলিয়ানি গ্রামে হানাদার সৈন্যরা লুটপাট করতে গেলে একজন মুক্তি যােদ্ধা একটি বাগান থেকে গ্রেণেড দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে একজন হানাদারকে খতম করেন।

স্বাধীনতাকামী যােদ্ধারা হাল্কা মেশিনগান ও রাইফেল দিয়ে অন্য একটি আক্রমণে ৩ জন শত্রু সৈন্যকে হতাহত করেন। হানাদার সৈন্যরা এর প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য উক্ত গ্রামে লুটপাট ও নির্যাতন চালাতে থাকে। গেরিলা যােদ্ধারা পুনরায় আক্রমণ চালিয়ে ২ জনকে খতম ও ২ জনকে আহত করেন। গত ৯ই আগষ্ট (সােমবার) যশােহরের নাভারণ এলাকায় গেরিলা যােদ্ধারা রাজাকারদের উপর এক  অতর্কিত হামলা চালান। এতে ৯৩ জন শক্র নিহত ও বহু আহত হয়। পরের দিন ভাের রাত্রে মুক্তিযােদ্ধারা একটি সেতু পাহারারত রাজাকারদের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৪ জনকে হত্যা করে। অন্যান্যরা কোন রকমে পালিয়ে যায় । | স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরে প্রকাশ, গত ১৮ই আগষ্ট সিলেটের লাতু অঞ্চলে মুক্তি বাহিনীর বীর। যােদ্ধাদের সাথে হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের আট-ঘণ্টা ব্যাপী প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়েছে। এই সংঘর্ষে মুক্তিযােদ্ধারা জীবনপণ করে হানাদার শত্রুদের উপর প্রবল আক্রমণ চালিয়ে যান এবং ৫৫ জন হানাদারকে খতম ও ৬৫ জনকে গুরুতর রূপে আহত করেন। সংঘর্ষে ৪ জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন।

সম্প্রতি সিলেটের কেরামতনগর রহিমপুর, বিয়ানী বাজার ও মৌলবী বাজারে বিভিন্ন সংঘর্ষে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে ৬ জন পাকিস্তানী সৈন্য ও ১ জন রাজাকার খতম হয়েছে। শিববাড়ী অঞ্চলে এক সংঘর্ষে ১১ জন পাকিস্তানী সৈন্য প্রাণ হারায় ও ১৩ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। | চিলমারী থানার উপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে গেরিলারা এক জন অফিসার সহ ৫ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশকে গুলী করে হত্যা করেন। সম্প্রতি বানিয়াবাজারে নদীর কাছে একটি লঞ্চ, দুটি স্পীড বােট ও ১৮টি নৌকা নিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা যাওয়ার সময় মুক্তিবাহিনী তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। এই আক্রমণে ৭৮ জন পাকিস্তানী সৈন্য খতম হয়। মুক্তিযােদ্ধারা সৈন্যবাহী একটি স্পীড বােট ও ১৭টি নৌকা ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হন। এই এলাকায় অন্য একটি সংঘর্ষে ২০জন শত্রুসৈন্য মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে প্রাণ হারায়। অন্য একটি সংঘর্ষে একজন দুঃসাহসী মুক্তিযােদ্ধা মেশিনগান হাতে নিয়ে শত্রু-বাঙ্কারের উপর ঝাপিয়ে পড়ে ১৫ জন হানাদারকে খতম করেন।  টাঙ্গাইলে গেরিলাযােদ্ধারা পাওয়ার হাউজের উপর সম্প্রতি গ্রেণেড আক্রমণ চালান। অন্য এক সংঘর্ষে গেরিলা টাঙ্গাইলে ৯ জন শত্রু সৈন্যকে খতম করেন । গত সপ্তাহে পাগলা-দেওয়ানহাটে এক সংঘর্ষে মুক্তিযােদ্ধারা ৩ জন হানাদারকে খতম করে। আলমপুরে মুক্তি বাহিনীর সাথে গুলী বিনিময়ে ১৩ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও ৭ জন গুরুতর রূপে আহত হয়।

রাজশাহী সেক্টর থেকে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, মুক্তিবাহিনীর কামড়ােরা ৪ঠা আগষ্ট রাজশাহী থেকে ৪০ মাইল উত্তরপূর্বেই আড়ানী রেল ষ্টেশনে একটি রাজাকার বাহিনীর উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। মর্টার ও মেশিনগানের গুলীতে শত্রুসেনার ৩ জন নিহত হয় এবং অন্যান্যরা পালিয়ে যায়। মর্টারের গােলাতে ষ্টেশনটি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কমান্ডােরা টেলিফোন যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফলে রাজশাহী ঈশ্বরদীর মধ্যে যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এই আক্রমণকে পর পর খান-সেনাবাহী। একটি ট্রেন উক্তপথ দিয়ে গমণকালে দুঃসাহসী কমান্ডােরা মাইনের সাহায্য ট্রেনটি উড়িয়ে দেয়। ফলে বহু শত্রুসেনা হতাহত হয়। পরে কমান্ডােরা আড়ানী বাজারে একটি ব্যাঙ্কে অবস্থানরত শত্রুসেনার পদলেহী দালালদের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৭ জন হত্যা করেন। এর কাছে বাঙ্কারে অবস্থানরত খানসেনারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পালিয়ে গেলে মুক্তিযােদ্ধারা বিপুল পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র দখল করেন। | সম্প্রতি তথাকথিত শান্তি কমিটির ১১ জন গুপ্তা অনুপনগরের জনৈক ডাক্তারকে হত্যা করতে গেলে বাংলার অতন্দ্র প্রহরী গেরিলাযােদ্ধারা এক অতর্কিত হামলা চালিয়ে ৩ জনকে হত্যা করেন। আমাদের সংবাদদাতা জানাচ্ছেন যে, গত ৭ই আগষ্ট মুক্তিবাহিনী মর্টার, মেশিনগান ও হাতবােমা নিয়ে গােদাগাড়ী থানায় অতর্কিত আক্রমণ চালায়। মর্টারের গােলার আঘাতে থানাটি বিধ্বস্ত হয় এবং দখলদার বাহিনীর তিনজন রাজাকার নিহত হয়।  গত ৫ই আগষ্ট কুমিল্লা সেক্টরে নয়নপুর শত্রু ঘাটিতে মুক্তিযােদ্ধারা এক অতর্কিত হামলা করে বহু খান-সেনা হতাহত করে। সম্প্রতি পাবনার শাহজাদপুরে খান সেনাদের পদলেহী দু’জন দালাল জামাতে ইসলামীর তথাকথিত নেতা মওলানা ওসমান গনি ও থানা ফুড ইন্সপেক্টরকে গেরিলাযােদ্ধারা হত্যা করেছেন। মওলানা ওসমান গত নির্বাচনে ভরাডুবির প্রতিশােধ হিসাবে সম্প্রতি শত্রু সেনাদের সহযােগীতায় খুব তৎপর হয়ে উঠে ছিল। এ সপ্তাহে শত্রু সেনার ক্ষয়ক্ষতি : ৩৮৭ জন হানাদার সৈন্য খতম। শতাধিক গুরুতররূপে আহত। ১১ জন দালাল নিহত ৩৮টি নৌযান বিধ্বস্ত।।

জয়বাংলা (১) ১ ১৫

২০ আগস্ট ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯ –জয়বাংলা