মুক্তি বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণের মুখে দিশেহারা পাক ফৌজ
মুক্তি বাহিনীর প্রচণ্ড মারের মুখে এখন পাক ফৌজ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। গত এক সপ্তাহের মধ্যে মুক্তি বাহিনীর গেরিলারা সিলেট, কুমিল্লা, নােয়াখালী এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে মােট ৮৮ জন পাক সৈন্য ও সরকারের তাবেদারদের খতম করেছে। গত পয়লা আগষ্ট মুক্তি বাহিনী কুমিল্লার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র উড়িয়ে দেয়। তাছাড়া শহরের আটচল্লিশ কিলােমিটার দূরে ঢাকা-কুমিল্লা রােডে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু মুক্তি বাহিনী। উড়েয়ে দেয়ার ফলে কুমিল্লার সাথে বাংলাদেশের অন্যান্য সব শহরের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। | ফেণীতেও মুক্তি বাহিনী তাদের তৎপরতা অব্যাহত রাখার ফলে শহরের চারটি বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র বােমার আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। | তাছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরে নিউমুরিং-এ একটি কয়লা ডিপােও মুক্তি বাহিনী ধ্বংস করে। এবং বন্দরের বাইরে ননাঙর করা একটি বিদেশী তেলবাহী জাহাজে তারা আগুনে বােমা নিক্ষেপ করার ফলে তাতে আগুন ধরে যায়। এই অবস্থা দেখে অপর দুটো বিদেশী তৈলবাহী জাহাজ ভয়ে পালিয়ে যায় । | মুক্তি বাহিনীর হাতে গত এক সপ্তাহে সিলেটের কমলপুর, কুমিল্লার মুকুন্দপুর ও কসবা এলাকায় মােট তিয়াত্তর জন পাক সেনা নিহত হয়েছে। ময়মনসিংহ মুক্তিযােদ্ধারা ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন স্থানে হানাদার পাক বাহিনীর উপর হামলা অব্যাহত রেখে তাদের নাস্তানাবুদ করে তুলছেন। তারা এ জেলার বিভিন্ন স্থানে হানাদার পাক বাহিনী, তাদের সহযােগী রাজাকার বাহিনী এবং তাদের তাবেদারদের নিকট থেকে ৭০টি রাইফেল উদ্ধার করেন।
বীর মুক্তিযােদ্ধারা বেগুণবাড়ীর বিখ্যাত রেল সেতুটি ধ্বংস করে দিয়ে ময়মনসিংহ-জামালপুরবাহাদুরাবাদ-জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের মধ্যে রেল চলাচল সম্পূর্ণ অচল করে দিয়েছেন। ফলে ঢাকার সাথে শত্রু বাহিনীর উত্তরবঙ্গ যােগাযােগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মুক্তিযােদ্ধারা গত ১৯শে জুলাই দুর্গাপুর থানার অন্তর্গত একটি গ্রামে রাতে টহলরত পাক বাহিনীর একজন সৈন্যকে হত্যা করে তার নিকট থেকে মেসিন গান দখল করেন। | ময়মনসিংহ শহরের পাশ্ববর্তী মুক্তাগাছা ও দাপুনিয়া এলাকার বিভিন্ন স্থানে যুগপৎ হানা দিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা পাক দালালদের কাছ থেকে ৪৭টি রাইফেল, স্টেনগান, মেসীনগান এবং আরও ৯টি মারাত্মক অস্ত্র ও গােলাবারুদ দখল করে নেন। জামালপুর মহকুমার হাজরাবাড়ী অঞ্চলে টহলদারী পাক দালাল রাজাকার বাহিনীর ১১ জন শসস্ত্র গুন্ডার উপর হামলা করে মুক্তি বাহিনী ৯ জনকে হত্যা এবং তাদের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র দখল করেন। অবশিষ্ট ২ জন রাজাকার মুক্তি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এখানে মুক্তি বাহিনী ১১টি রাইফেল উদ্ধার করেন। মুক্তিযােদ্ধারা ১৪ই জুলাই থেকে ১৬ই জুলাই পর্যন্ত বদরপুর থানা শান্তি কমিটির সহ-সভাপতি এবং অপর একজন পাক দালালকে খতম করেন। বীর মুক্তিযােদ্ধারা থানা উন্নয়ণ বিভাগীয় সি ও এর অফিসে হামলা করে সকল দলিল পুড়িয়ে দেন। তারা পাক রেঞ্জারদের দখলীকৃত বাংলােতে হাত বােমা নিক্ষেপ করেন। মুক্তিযােদ্ধারা সরাচরে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ-এর উপর হাত বােমা নিক্ষেপ করে এটার ক্ষতি সাধন করেন। ভৈরব বাজার থানা, পােষ্ট অফিস এবং টেলিগ্রাফ অফিসে মুক্তিযােদ্ধারা হামলা করে অফিসের কাগজপত্র ধ্বংস করে দেন।
টাঙ্গাইল সম্প্রতি মুক্তিযােদ্ধারা কালীহা থানার বল্লায় পাক সেনাদের ঘাটিতে চারদিক থেকে যুগপৎ আক্রমণ করে ২৪ জন পাক সেনা খতম এবং ৪৫ জনকে আহত করেন। মুক্তি বাহিনী এখানে ৮টি রাইফেল, ১টি মেসীনগান এবং প্রচুর গােলা বারুদ দখল করে নেন। উল্লেখযােগ্য যে, এই জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা এখন মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে রয়েছে। মুক্ত এলাকার পাক সেনাদের দালাল থানার দারােগা-পুলিশদের গ্রেফতার এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি বাসাইল অভিমুখে যাবার সময় কান্তা ফেরীঘাটে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালান। পাক সেনারা আর অগ্রসর হতে ভরসা না পেয়ে পজিশান নিয়ে গুলী চালায়। কিন্তু দুর্ধষ্ণু মুক্তিযােদ্ধাদের বেপরােয়া আক্রমণের মুখে তারা দিশেহারা হয়ে যায়। এই সংঘর্ষে ১৯ জন খান সেনা খতম এবং ৬০ জন আহত হয়। অবশিষ্টরা ৮টি মৃতদেহ ফেলে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। মুক্তিযােদ্ধারা এখানে ২টি মেসীন গান, ৯টি রাইফেল ও প্রচুর গােলাবারুদ দখল করেন। ঢাকা। ২৮শে জুলাই রাতে মুক্তিযােদ্ধারা ঢাকার কমলাপুর রেল ষ্টেশনে দু’টি বােমা ফেলে আশে পাশের এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা অচল করে দেন। জানা গেছে যে, ঢাকার সঙ্গে সংযােগ রক্ষাকারী বিভিন্ন সেতুর সামনে হানাদার পাক সেনারা পাহাড়াদার বসিয়েছে। | বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, মুক্তিযােদ্ধারা রায়পুরা থানায় বেলাব বাজারের নিকট পাক সেনা বহনকারী ২টি নৌকা আক্রমণ করেন। এতে ২০ জন খান সেনা খতম হয়। এরপর খান সেনারা এসে ১৫০ জন নিরীহ গ্রামবাসিকে হত্যা করে। তারা বেলাব বাজারেরও ক্ষতি সাধন করেছে বলে জানা গেছে। ২৮শে জুলাই আশুগঞ্জের নিকট মান্দ্রাবাগ এলাকায় পাক হানাদারদের উপর মর্টার দিয়ে গুলী করে ৩ জন পাক সেনাকে খতম করেন।
বিলম্বে প্রাত্য অপর এক খবরে প্রকাশ, ১৫ই জুলাই নরসিংদীর নিকট মাইন বিস্ফোরণ হয়ে একটি ডিজেল ইঞ্জিন এবং ৪টি বগী লাইনচ্যুত হয়ে যায় । | ৮ই জুলাই মুক্তিযােদ্ধারা শিবপুরে একজন পাক দালালকে খতম এবং রেজাকারের নিকট থেকে একটি রাইফেল উদ্ধার করেন। কুষ্টিয়া-যশাের-খুলনা। মুক্তিযোেদ্ধারা সম্প্রতি গােপালপুরের নিকটে মালপুর থানা আক্রমণ করেন। এই আক্রমণে পাক হানাদার সেনাদের সহযােগী ৩ জন পুলিশ নিহত এবং ২ জন আহত হয়। থানার নিকটে পার্কিং করা একটি জীপও মুক্তিযােদ্ধারা ধ্বংস করেন। ২৫শে জুলাই মুক্তিযােদ্ধারা আলমডাঙ্গা এবং হালমার মাঝামাঝি স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের একটি টাওয়ার বিধ্বস্ত করে দেন। এর ফলে শত্রু কবলিত আলমডাঙ্গা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া, আলমডাঙ্গার নিকট মুক্তিযােদ্ধাদের মাইন বিস্ফোরিত হয়ে পাক সেনাবাহী একটি ট্রেণ লাইনচ্যুত হয়। এতে ১৫জন পাক সেনা নিহত হয়। রেলের বগীটি বিধ্বস্ত হয়। তারা আলমডাঙ্গা টেলিফোন এক্সচেঞ্জে হামলা করেন। এই হামলায় একজন অপারেটর নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা চুয়াডাঙ্গা এবং নীলমণিগঞ্জের মধ্যে একটি রেলসেতু উড়িয়ে দিয়ে পাক সেনাদের চলাচল ব্যাহত করেছেন। | মুক্তিযােদ্ধারা নবকাটি এবং ভােমরায় পাক-সেনাদের উপর মর্টারের সাহায্যে গােলাবর্ষণ করেন। এতে ৮জন খান সেনা খতম হয়। মুক্তিযােদ্ধারা এই এলাকায় খান সেনাদের ৪টি বাঙ্কারও ধ্বংস করে দেন। কুলিয়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান কুখ্যাত পাক দালাল জনাব আবদুল মজিদ মুক্তি যােদ্ধাদের হাতে খতম হয়। মুক্তি যােদ্ধারা এই দালালের বাড়ীও পুড়িয়ে দেন। মধুখালি এবং দস্তিনায় ১০জন পাক সেনা খতম হয়। তারা হার্ডিজ ব্রীজ এলাকায় একটি ইলেকট্রিক সাব-ষ্টেশন ধ্বংস করে দেন। হরণকুণ্ডা এলাকায় ৫জন পাক দালাল খতম করা হয়। মুক্তি যােদ্ধারা এই এলাকায় টেলিফোজের ৩ শত গজ তার উঠিয়ে নিয়ে যান। দোস্তার কুখ্যাত মুসলিম লীগ নেতাকে খতম করা হয়। ঈশ্বরদী, পাবনা, মনােহরপুর এলাকায় ৪টি ইলেকট্রিক টাওয়ার ধ্বংস এবং টেলিফোন লাইন খুলে নিয়ে যান।
জয়বাংলা (১) ১ : ১৩
৬ আগস্ট ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯ –জয়বাংলা