You dont have javascript enabled! Please enable it!

এ এক অনন্য যুদ্ধ

পাক সমর নায়করা বিশ্বাস করতেন, বাঙলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে বাঙালীদের পদানত করে রাখা সম্ভব হবে। তারা চেয়েছিল নির্বিচারে বাঙালীদের হত্যা করে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করতে। বিখ্যাত সাংবাদিক এন্টনি মাসকারেণহাস লিখেছেন, তাঁকে পাকিস্তানের কোন সমর নায়ক বলেছেন, প্রয়ােজন হলে পাক বাহিনী বিশ লাখ বাঙালীকে হত্যা করতে প্রস্তুত। কিন্তু তাদের এই নির্বিচার গণহত্যার নীতি বাঙালীর মনে উল্টা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বাঙালী আজ মরণ পন সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ । তারা আজ মৃত্যুভয়ে ভীত নয়। গত চার মাসে এ মুক্তি বাহিনী অনেক সুসংগঠিত হয়ে উঠেছে। তাদের প্রতিআক্রমণে পাক বাহিনী আজ ভীত সন্ত্রস্থ। আমেরিকার বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা নিউজ উইক এর হিসাব অনুসারে ৩০,০০০ বাঙালী মুক্তিযােদ্ধা আজ বাঙলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ করে চলেছে।  

আর এদের হাতে মৃত্যু ঘটছে বহু সংখ্যক পাক সৈন্যের। পাক-বাহিনীর রণনীতিতে এসেছে মৌলীক পরিবর্তন। পাক-বাহিনী লাফিয়ে পড়েছিল বাঙলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর। তার রণনীতি ছিল আক্রমণাত্মক। কিন্তু আজ তার রণনীতি হয়ে উঠেছে আত্মরক্ষামূলক। পাক বাহিনী আজ চাচ্ছে ঘাটি। আগলে থাকতে। পাক সেনাবাহিনীতে সৈন্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সারা বাঙলাদেশে দখল বজায় রাখবার মত যথেষ্ট সৈন্য পাক বাহিনীতে এখন আর নেই। বিদেশী পত্রিকার হিসাব অনুসারে খুব কম করে হলেও ১৭,০০০ সৈন্য মারা গেছে অথবা আহত হয়ে অকেজো হয়ে পড়েছে। পাক-বাহিনীর অস্ত্র আছে যথেষ্ট। কিন্তু এই অস্ত্র চালাবার লােকের অভাব ক্রমশঃ তীব্র হয়ে দেখা দিচ্ছে এইটাই হল বিদেশী একাধিক সাংবাদিকের অভিমত। নিউজ উইকে বলা হয়েছে, পাক-বাহিনী যথেষ্ট অস্ত্রে সজ্জিত। কিন্তু এই বাহিনী বাঙলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে থেকে যুদ্ধ করে যেতে পারবে না। কারণ, প্রয়ােজনের তুলনায় পাক সেনা সংখ্যা মােটেই পর্যাপ্ত নয়।  শুধু অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ চলেনা। অস্ত্র চালাবার জন্য প্রয়ােজন হয় জনবল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যথেষ্ট সৈন্য আমদানীর গতি এখন মন্থর হয়ে পড়েছে। | পাক-বাহিনী তাদের জনবল বৃদ্ধির জন্য অবাঙালীদের মধ্য থেকে লোেক সংগ্রহ করে একটি সহকারী বাহিনী গড়ে তুলেছে। এই বাহিনীর নামকরণ করা হয়েছে রাজাকার। কিন্তু এই রাজাকার বাহিনী দিয়ে কোন কাজ হচ্ছে না। মুক্তি বাহিনীর হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে ওদের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে। বাঙলা বাহিনী জনসাধারণের সহযােগীতা পাচ্ছে, কিন্তু এই অবাঙালী ফৌজেরা পাচ্ছে না। পাক-বাহিনীর মতই এরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন বাহিনী। বাঙলাদেশের মানুষ ও মাটির সাথে এদের কোন যােগাযােগ নেই।

বাঙলাদেশ বাহিনীর এখন যুদ্ধনীতি হচ্ছে গেরিলা যুদ্ধের নীতি। লুকিয়ে থেকে হঠাৎ শত্রুকে আক্রমণ করা ও সরে পড়াই হল এই যুদ্ধনীতির গােড়ার কথা। এর উদ্দেশ্য হল শত্রুর সেনা বাহিনীকে দুর্বল করা। তাদের সরবরাহ ব্যবস্থা বানচাল করা। এক কথায় আঘাতের পর আঘাত হেনে শত্রুকে নাকানি চুবানি খাইয়ে পরাজয়ের মুখে ঠেলে দেয়াই এই গেরিলা আক্রমণের মূল লক্ষ্য। দীর্ঘ দিন যুদ্ধ চালিয়ে যাবার ক্ষমতা পাক সরকারের নেই। পাকিস্তানকে সেনা ও গােলাবারুদ নিয়ে আসতে হচ্ছে সিংহল ঘুরে । এত দূর থেকে যুদ্ধ চালাবার ব্যয় ভার বহণ করতে গিয়ে পাক অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ছে। পাকিস্তানে গােলাবরুদ ও অস্ত্রপাতি খুব কমই প্রস্তুত হয়। পাকিস্তানকে গােলাবারুদ ও অস্ত্রের জন্য নির্ভর করতে হয় বিদেশের উপর। বিমান, ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া গাড়ী চালাবার জন্য যে তেলের প্রয়ােজন হয় তাও আসে বিদেশ থেকে। কিন্তু বিদেশের উপর নির্ভর করে দীর্ঘ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানকে আপাততঃ সাহায্য করছে। কিন্তু আমেরিকার জনসাধারণ পাকিস্তানের জঙ্গীচক্রকে সাহায্য দেবার বিরােধী। নিক্সন সরকার তার দেশের জনমতকে কতদিন উপেক্ষা করতে পারবেন, বলা যায় না। | চীন এমন একটি গোয়ার জঙ্গী সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে যার উপর জনগণের কোন বিশ্বাস বা আস্থা নেই। তবুও যদি চীন পাকিস্তানকে সাহায্য করে যায়, সেই সাহায্যের উপর ভর করেও পাকিস্তান দীর্ঘ যুদ্ধ চালাতে পারবে না। কারণ, যুদ্ধ কেবল অস্ত্র দিয়ে হয়না। যুদ্ধ করে মানুষ। সেই মানুষের অভাব ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে পাক বাহিনীতে। বলা হয়ে থাকে বন্দুকের নলা থেকে সব রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে। কিন্তু ভুলে গেলে চলেনা বন্দুকটি চালাবার জন্য প্রয়ােজন হয় একটি মানুষ। মানুষটির কথা বাদ দিয়ে বন্দুকের কথা ভাবা অর্থহীন। 

পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমানে করেও সামরিক সরবরাহ ও সৈন্য আনা হয়। কিন্তু এতে খরচা পড়ে খুবই বেশী। প্রত্যেকটি সৈন্যকে আনতে খরচা পড়ে ৯০০ টাকার উপর। তা ছাড়া পাকিস্তানে বিমানের সংখ্যা এত অধিক নয় যে তার সাহায্যে দূর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সব কিছু আনাবেন। একজন মার্কিন সামরিক বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছেন ।  পাকিস্তান প্রথম দিকে বিমানে করে সৈন্য ও রণসম্ভার বয়ে আনার খুবই কৃতিত্ব দেখিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানকে শীগগীরি সৈন্য চলাচল ও সরবরাহের ক্ষেত্রে অসুবিধায় পড়তে হবে। কারণ বাঙলাদেশে ক্রমশঃ গেরিলা যুদ্ধ তীব্রতর হতে থাকবে। এর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে সৈন্য চলাচল ও সরবরাহ ব্যাপারে পাকিস্তানকে আরাে ক্ষিপ্র হতে হবে। কিন্তু পাক সামরিক চক্রের সে সঙ্গতি নেই। তাদের লজিসটিস্-এর নানা জটিল সমস্যায় জড়িয়ে পড়তে হবে।

জয়বাংলা (১) ১ : ১৩।

৬ আগস্ট ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯ –জয়বাংলা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!