You dont have javascript enabled! Please enable it!

সারা বাঙলাদেশে জোর লড়াই চলিতেছে ময়মনসিংহের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্তিফৌজের দখলে

(নিজস্ব সংবাদদাতা) ময়মনসিংহ ২৫শে জুলাই। ইয়াহিয়া বাহিনী নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তান রেডিও অহরহ প্রচার করিতেছে বাঙলাদেশের অবস্থা নাকি স্বাভাবিক। কিন্তু ইহা যে কত বড় মিথ্যা তাহার একটি প্রমাণ হইল ময়মনসিংহ জিলার সত্যিকারের চিত্র ময়মনসিংহের কতকগুলি স্থান এখনও পাকবাহিনীর দখলে বাহিরে। রহিয়াছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, সদর মহকুমার ত্রিশাল, ভালুকা, ফুলবাড়ীয়া, গফরগাঁও প্রভৃতি এলাকায় প্রায় এক সহস্র মুক্তিফৌজ রহিয়াছেন। এই মুক্তিফৌজ ঐ সব এলাকায় মুসলিম লীগপন্থী ও জামায়াত ইসলামপন্থী কতকগুলি লােককে, যাহারা পাকবাহিনীর দালালি করিতেছিল তাদের খতম করিয়াছেন। প্রকাশ যে, এই এলাকায় মুক্তিবাহিনীর কাজকর্মের জন্যই ইয়াহিয়া সরকার রাজাকারবাহিনী গড়িয়া তুলিতে পারে নাই।  মুক্তিফৌজকে চারিদিকে হইতে ঘিরিয়া ফেলার জন্য ইয়াহিয়া সরকার ফুলবাড়ীয়া থানার কিশােরগঞ্জ প্রায় এক হাজার সৈন্য সমাবেশ করিয়াছেন। ইহাদের পরিকল্পনা হইল যে উত্তর ও পূর্ব দিক হইতে দ্বিমুখী সাঁড়াশি অভিযান চালাইয়া ঐ মুক্তিফৌজকে পিসিয়া মারা। ইহাছাড়া ইয়াহিয়া সরকার হেলিকপ্টার যােগে মুক্তিবাহিনীর পশ্চাদভাগেও সৈন্য নামাইবার পরিকল্পনা নিয়াছে বলিয়া শােনা যাইতেছে। | তবে, মুক্তিফৌজও এই সময় আক্রমণ মােকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হইতেছে।

সদর মহকুমার ঐ অঞ্চল ব্যতীত নেত্রকোণায় ও জামালপুরের কতকগুলি অঞ্চলেও মুক্তিফৌজ তৎপর রহিয়াছে। মুক্তিফৌজের একটি দল সম্প্রতি ময়মনসিংহ শহর হইতে, রেলপথে বেগুনবাড়ী যাওয়ার সেতুকে সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংস করিয়াছে। নেত্রকোণা মহকুমার ঠাকুরকোণার সন্নিকটে রেল সেতুটির মুক্তিফৌজ বিশেষ ক্ষতি করিয়াছে বলিয়া প্রকাশ। গত ১৯শে জুলাই নেত্রকোণা মহকুমারই দুর্গাপুর থানার অধীনে একটি গ্রামে কয়েক জন পাকসেনা প্রবেশ করিয়া অত্যাচার করিতে থাকিলে গ্রামের ৪ জন যুবক খালি হাতেই অসম সাহসিকতার সহিত একজন পাকসেনাকে ধরিয়া ফেলিয়া ঐ বর্বর সৈন্যটিরে এল এম জি কাড়িয়ে নেয় এবং ঐ সেনার বেয়নেট দিয়া তাহাকে ঘায়েল করে। জামালপুর মহকুমার উত্তরাংশে অন্তরের নিকট ১৯শে জুলাই মুক্তিফৌজের সঙ্গে পাকবাহিনীর এক প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। যদিও পাক সেনাবাহিনীর বেপরােয়া গুলি বর্ষণে কয়েক জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হইয়াছেন কিন্তু মুক্তিফৌজের সাহসিকতাপূর্ণ আক্রমণের ফলে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং বাকী প্রায় ১৫/২০ জন দৌড়াইয়া পালাইয়া যায়। | এই ঘটনার কয়েক দিন পূর্বে মাত্র ৪ জন মুক্তিফৌজ একটি স্টেনগান সম্বল করিয়া ফুলপুর থানা আক্রমণ করে। ইহাদের দেখিয়াই থানার পুলিসরা পালাইয়া যায়। মুক্তি ফৌজ কয়েকটি রাইফেল ও একটি ট্রানসমিটার যন্ত্র নিয়া চলিয়া আসে। 

প্রকৃতপক্ষে, সারা ময়মনসিংহ জিলাতে পাক সেনাবাহিনী মুক্তিফৌজ কখন আক্রমণ করে এই ভয়ে সন্ত্রস্ত হইয়া রহিয়াছে। ইহারা এখন বড় বড় বন্দর ও শহরগুলিতে ঘাটি গাড়িয়া বসিয়া আছে। গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করিয়া যেসব গ্রামে ভাল রাস্তাঘাট নাই সেইসব গ্রামে পাক সেনাবাহিনী খুব কমই যায়। সেই সমস্ত স্থানে ইয়াহিয়া সরকার দালালদের মারফত রেজাকার বাহিনী গড়িয়া তাহাদের মাধ্যমে ঐসব স্থান তাহাদের দখলে রাখার চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু বহুস্থানে এইসব দালালের মুক্তি ফৌজের হাতে খতম হওয়ার ফলে তাহার (দালালরা) এখন আর নিজ গ্রামে থাকিতেছে না। তাহারা মিলিটারি ক্যাম্প-এ আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে এবং সেসব স্থানে বসিয়াই পাক মিলিটারিকে নানা সংবাদ সরবরাহ করে। অন্যদিকে রেজাকার বাহিনীগুলি ডাকাত দলে পরিণত হইয়াছে।

উপরােক্ত অবস্থায় ময়মনসিংহের বহু গ্রামাঞ্চলে এখন প্রকৃতপক্ষে ইয়াহিয়া সরকারের কোন প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও স্বাভাবিক অর্থনৈতিক জীবন নাই। বহু গ্রামে অবাধে চুরি ডাকাতি চলিতেছে। বিস্তীর্ণ প্রামাঞ্চলে মানুষ লতাপাতা সিদ্ধ ও একবেলা ভাত খাইয়া কায়ক্লেশে জীবন ধারণ করিতেছে।  মুক্তিফৌজের দুর্বলতা হইল যে, যে সমস্ত গ্রামে তাঁহারাই প্রধান শক্তি যেমন, ফুলবাড়ীয়া, ত্রিশাল প্রভৃতি সেখানে তাহারাও কোন পাল্টা প্রশাসনিক ব্যবস্থা স্থাপন করিতেছেন না।।  তাহারা যদি এখন এইসব অঞ্চলে নিজেদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে জরুরী প্রয়ােজনীয় ভূমি সংস্কার খাদ্যের সুষ্ঠু বিতরণ প্রভৃতি কাজে হাত দেন তাহা হইলে সেইসব অঞ্চলগুলি সত্যিকারের মুক্ত এলাকা হিসাবে গড়িয়া উঠিতে পারে এবং মুক্তিফৌজ জনগণের ব্যাপকতম ও দৃঢ়তম সমর্থন পাইবেন। তখন অস্ত্রশস্ত্র সুসজ্জিত ইয়াহিয়া বাহিনীর পক্ষেও ঐসব এলাকায় মুক্তিফৌজকে পরাজিত করা সুকঠিন হইয়া উঠিবে।

মুক্তিযুদ্ধ : ১: ৪ :

১ আগস্ট ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯ –মুক্তিযুদ্ধ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!