You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.02 | রণাঙ্গনে - সংগ্রামের নোটবুক

রণাঙ্গনে | জয় বাংলা পত্রিকা | ২ জুলাই ১৯৭১ 

একজন পাক সেনা থাকা পর্যন্ত মুক্তি ফৌজের সংগ্রাম চলবে মুজিবনগর। মুক্তিফৌজের দুই রণাঙ্গনের কমান্ডারদ্বয় মেজর খালিদ মুশারফ ও মেজর জিয়াউর রহমান এক সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে বলেছেন, বাংলা দেশের পবিত্র মাটি থেকে পাক-সামরিক বাহিনীর একেবারে  চলে না যাওয়া পয্যন্ত দেশের পরিস্থিতি কখনও শান্ত হতে পারে না এবং তত দিন পর্যন্ত মুক্তিফৌজের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। | তারা দুজনেই ইয়াহিয়ার ভাষণকে ডাহা মিথ্যার ছড়াছড়ি বলে আখ্যায়িত করেন। যতই দিন গড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের মুক্তিবাহিনীর গেরিলাযােদ্ধারা হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের ওপর আক্রমণাত্মক তৎপরতা ততই জোরদার করে তুলছেন। গত তিন মাসে হানদার সেনারা যেভাবে চরম মার খেয়েছে তার একটা ছােট্ট প্রমাণ মেলে বি-বি-সি’র প্রচারিত সংবাদের মাধ্যমে। গত ২৪শে জুন সন্ধ্যা সােয়া আটটার সংবাদ প্রবাহে বি-বি-সি’র সংবাদদাতা ঢাকা থেকে বলছেন, ‘বাংলাদেশে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মুক্তিবাহিনী গেরিলাদের হাতে পাক সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির যে তথ্য আমি সংগ্রহ করেছি তার ভগ্নাংশও সত্য হলে তা হবে ভায়বহ। অন্যদিকে রয়টারের সংবাদদাতা হাওয়ার্ড হুইটেন জানাচ্ছেন, ‘প্রতিদিন ৫০/৬০ জন আহত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যকে চিকিৎসার জন্য ঢাকার হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছে। বিদেশী কূটনীতিকদের মতে বাংলাদেশের দখলীকৃত ঢাকায় হানাদার পাক-সেনাদের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণাত্মক তৎপরতা প্রতিদিন জোরদার হচ্ছে। সাতক্ষীরায় ৬০০ জন নিশ্চিহ্ন সাতক্ষীরায় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ৬০০ শত্রু সেনা নিহত হয়েছে। এ ছাড়া মােট ২৬টি আক্রমণে তারা ৩০০ জন পাকসেনাকে খতম করেন। ভােমরা, পারুলিয়া, মামুদপুর, খুসকালি শ্রীপুর ও কাকডাঙ্গায় আক্রমণ চালানাে হয়। ফেণীতে প্রচণ্ড সংঘর্ষে ৫ শতাধিক শত্রুসেনা খতম পূর্বাঞ্চল সেক্টরের ফেণী মহকুমায় গত এক পক্ষ কালের প্রচণ্ড সংঘর্ষে স্বাধীনতাকামী তরুণ যােদ্ধাদের হাতে প্রায় পাঁচ শত পশ্চিম পাকিস্তানী শত্রু সেনা খতম হয় এবং দু’শত জন মারাত্মকভাবে আহত হয়।

 স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরে প্রকাশ, উক্ত সংঘর্ষে আমাদের মুক্তিসেনাদের ৫০জন কমান্ডাে আহত হন। গত ৪ঠা জুন খান সেনাদের গতিরােধ করার উদ্দেশ্যে পাঠান নগরের বশিকপুর সেতুতে মুক্তিবাহিনীর মাইনে পোঁতা বিস্ফোরণের পর এ সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় এবং এক পক্ষকাল ধরে এই সংঘর্ষ চলতে থাকে। কুমিল্লা রণাঙ্গনে গেরিলা বাহিনীর হাতে প্রায় ৯০ জন খান সেনা নিহত হয়। পরে মুক্তি যােদ্ধাদের তাড়া খেয়ে পাক-ফৌজ কর্ণেল বাজারে আশ্রয় নেয়। গত ২২শে জুন কুমিল্লার মান্দাভাগে ৫ জন সৈন্য নিহত হয়। ঢাকায় বােমা বিস্ফোরণ অব্যাহত রয়টারের সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, সম্প্রতি জাতিসংঘ উদ্বাস্তু হাই কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খানের ঢাকা সফরের সময় ঢাকায় আটটি বােমা বিস্ফোরিত হয়। হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে গেরিলা যােদ্ধাদের গ্রেণেড আক্রমণে একজন আহত হয়। আরেকটি আক্রমণে ৩ জন খান সেনা নিহত হয়।

স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরে প্রকাশ, গত ২৩শে জুন চারটায় ঢাকা বিমান বন্দরে একটি বােমা বিস্ফোরণের পর বন্দর পাহারারত দখলকার দস্যুসৈন্যদের মধ্যে থমথমে ভাব বিরাজ করছে। আমাদের ঢাকা প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, ঢাকা বিমান বন্দরে বিদেশী সাংবাদিকদের নিয়ে একটি বিমান অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে বিকট আওয়াজ করে একটি বােমা বিস্ফোরিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের। দখলীকৃত এলাকায় অবস্থা যে মােটেও স্বাভাবিক নয়, ঢাকার মাটিতে পা দিতেই বিদেশী সাংবাদিকগণ  তা প্রত্যক্ষ করলেন। হানাদারদের কড়া পাহারা সত্ত্বেও এ ধরনের বিস্ফোরণ হওয়ায় বর্বর পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা ব্রিত হয়ে পড়ছে। গত সপ্তাহে রাজশাহীতে পর পর তিনদিন সারা শহরে বােমা বিস্ফোরিত হলে খান সেনারা ভীত বিহ্বল হয়ে পড়ে এবং এখন তাদের বড় একটা ছাউনী থেকে বের হতে দেখা যাচ্ছে না। রাজশাহী শহর আক্রান্ত আমাদের স্বাধীনতাকামী তরুণরা রাজশাহী শহরে ঢুকে প্রবল আক্রমণ চালিয়েছেন। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডােরা গত রােববার রাতে তিন দিক থেকে শহরটিতে প্রবেশ করেন। এ সব আক্রমণে পাক সেনাবাহিনী বড় বেকায়দায় পড়েছে। মুক্তিবাহিনী মীরগঞ্জ, চারঘাট ও নবাবগঞ্জ—এই তিন দিক থেকে রাজশাহী শহরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এ আক্রমণকালে মুক্তিবাহিনী মর্টার, হাতবােমা ও হাক্ষী মেশিনগান ব্যবহার করেন। 

এক খবরে প্রকাশ, মুক্তিবাহিনী ও পাক সেনাদের মধ্যে নােয়াখালী, সােনামুরি ও চট্টগ্রাম রণাঙ্গনেও প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। গেরিলা বাহিনী পাক-সেনাদের একটি জীপ মাইন দিয়ে উড়িয়ে দেয়। তাতে ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। চট্টগ্রামে ও ননায়াখালীতে পাক টহলদার বাহিনীর ৬ জন সৈন্য গেরিলাদের হাতে নিহত হয়। শনিবারের সংঘর্ষে ৬০ জন সৈন্য নিশ্চিহ্ন মুক্তিবাহিনী গত ২৬শে জুন বিভিন্ন রণাঙ্গনে ব্যাপক আক্রমণ চালান। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চল সেক্টরে কমপক্ষে ৬০ জন শত্রুসৈন্য নিহত হয় এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী কিছু অস্ত্র শস্ত্র দখল করে নিয়েছেন। | গত ২২শে জুন কুষ্টিয়ার একটি গ্রামে মুক্তিবাহিনী গেরিলাদের আক্রমণে ১৬ জন পাক হানাদার খতম হয়েছে। গেরিলাদের সঙ্গে বৈদ্যনাথতলা ও কৃষ্ণনগরের কাছে দু’টি আলাদা জায়গায় পাক হানাদারদের ৬ ঘণ্টাব্যাপী গােলা বিনিময় হয়। উভয় পক্ষই মর্টার নিয়ে আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ চালায়। খুলনা জেলার গনরাখালিতে পাক-সেনা ভর্তি ট্রাকের ওপর গেরিলাবাহিনী আক্রমণ করেন এবং এখানেও কিছু পাক-সৈন্য নিহত হয়। দালালরা খতম হচ্ছে। বিভিন্ন শহর-গ্রাম থেকে মুসলিম লীগ ও জামাত-ই-ইসলামের গুন্ডা ও হানাদার সৈন্যের পদলেহী দালালদের খতম করা কাজ ব্যাপক হারে শুরু হয়েছে। এর মধ্যে মুক্তিফৌজ পাটকেলঘাটা, টালা, পাইকগাছা, আশাশুনি, বদরতলা, কালােরােয়া প্রভৃতি স্থানে ১৬ জন দালালকে গুলী করে হত্যা করেছেন।

জয়বাংলা (১) 1: ৮

২ জুলাই ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯ –জয়বাংলা