You dont have javascript enabled! Please enable it!

রণাঙ্গনে

খান সেনাদের ওপর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ তীব্রতর হয়েছে আরও সাত শতাধিক সৈন্য খতম স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারের খবরে প্রকাশ, হানাদারবাহিনী বাংলাদেশে যে বর্বরােচিত ও সুপরিকল্পিত গণহত্যা চালিয়েছে তারই অংশ হিসাবে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও তাদের সমর্থকদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। এই নির্মম অত্যাচারের হাত থেকে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজীবের বয়ােবৃদ্ধ অসুস্থ পিতামাতাও রেহাই পাননি। | খুনী ইয়াহিয়ার বন্য সৈন্যসামন্তরা তাদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ীঘর লুট করে এবং পরে পুড়িয়ে দেয়। তাদের আত্মীয় স্বজনের ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালায়। পাকসৈন্যরা মহান নেতার জন্মস্থান টুঙ্গীপাড়া গ্রামটির সর্বত্র এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর দুজন সহ গ্রামের বহু নিরীহ লোেককে তারা হত্যা করে। হানাদারবাহিনী প্রিয় নেতার ৯০ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ বাবা এবং অসুস্থ মাকে পর্যন্ত লাঞ্ছিত করতে ছাড়েনি। যাওয়ার সময় দস্যু ও পাক-সৈন্যরা মহান নেতার বাড়ীর মূল্যবান জিনিষপত্রর লুট করে পরে বাড়ীটাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। | গত সাতদিনে চট্টগ্রাম রণাঙ্গণে প্রায় একশত ৫০ জন পাক হানাদার মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের হাতে নিহত হয়েছে এবং বহু স্থান থেকে পাক-সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে বলে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র জানিয়েছে। সমগ্র পূর্ব রণাঙ্গনে গেরিলাদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কক্সবাজারে বহু পাক-সেনা হতাহত হয়েছে। 

এদিকে মর্টার ও মেসিনগানসহ আক্রমন চালিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা ফেনীর উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ২০০ জন পাক-সেনাকে হত্যা করেছেন।স্বাধীনতাকামী তরুণ যােদ্ধারা গত ১৯শে জুন সিলেট সেক্টরে একটি এলাকায় পাক-হানাদারদের  সঙ্গে এক সংঘর্ষে ১৩ জন পাকসেনাকে খতম করেন এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদসহ ৩ জন পাকফৌজকে আটক করেছেন। এর আগের দিন এক প্রচণ্ড সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী সিলেটের কয়েকটি স্থানে আক্রমণ চালিয়ে কয়েকটি শত্রুসেনার বাঙ্কার নষ্ট করেছেন এবং ৩০ জন সৈন্যকে খতম করেছেন। এই আক্রমণে ২২তম রেজিমেন্টের একজন সৈন্যকেও আটক করেছেন। মুক্তিবাহিনী রংপুরের বজরাপাড়ায় পাক-সেনাদের ওপর অতর্কিত গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাদের নাজেহাল করে ছেড়েছেন। এই আক্রমনে অনেক খান-সেনা হতাহত হয়েছে। সেই দিনই পাক-সেনারা মৃত সৈন্যদের লাশ ও আহত সৈন্যদের নওগাঁ নিয়ে যায়। এই আক্রমণে একজন অফিসারসহ দুজন পাক-সেনাকে মুক্তি বাহিনীর বীর যােদ্ধারা ঠাকুরগাঁয়ের কাছে মর্টার ও মেশিনগান থেকে শত্রু ছাউনীর উপর আচমকা গুলী চালায়।

চট্টগ্রামে ও মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছ। গত দু সপ্তাহ ধরে চট্টগ্রামে অধিক সংখ্যক গাড়ী ও সৈন্য নিয়ে পাক সেনাদের চলাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। কুষ্টিয়া রণাঙ্গনের মেহেরপুর এলাকায় এক দুসাহসিক আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী কমপক্ষে ৩০। জন পাক সেনাকে খতম করেছেন, সেখানকার কুতুবপুরে মুক্তিবাহিনী খান-সেনাদের উপর আকস্মিকভাবে ঝাপিয়ে পড়ে ১০ জন পাক-সেনাকে হত্যা করেন। গত ১৫ই জুন নাজিরাকোনায় এক প্ল্যাটুন পাক-সেনাকে আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী যােদ্ধারা ২০ জন দুশমন সৈন্যকে খতম করেছেন। স্বাধীনবাংলা বেতারের খবরে প্রকাশ, সাতক্ষীরার নিকট দুশমন সৈন্যদের ঘাঁটির উপরও মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ চালিয়েছেন। ঐ এলাকায় কয়েকটি আউট-পােষ্টও আমাদের মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে দস্যু সৈন্যদের অনেকেই হতাহত করেছেন। গত ১২ই জুন ডােমরা সেক্টরের কলাবােয়ায় মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে ১৬ জন খানসেনাকে খতম করেছেন। মুক্তিবাহিনী ঐ দিন রাতে আরেক অভিযানে ৬০ জন খান-সেনা হত্যা করেছেন। কলারােয়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও তথাকথিত শান্তি কমিটির প্রেসিডেন্ট ওয়াজেদ আলী চৌধুরীকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যােদ্ধারা খতম করেছে।

মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম খণ্ডে বিশিষ্ট এলাকায় খান-সেনার উপর ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে মেহেরপুরের নিকটে এক পল্টন খান-সেনাকে খতম করেছেন। মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর শহর থেকে প্রায় দু মাইল দূরে কামদেবপুর গ্রামে ইছাখালী সীমান্ত চৌকি দখল করে নিয়েছে। এতদাঞ্চলে মটার থেকে গুলীবর্ষণ করে মুক্তিবাহিনী শত্রুসেনাদের এক পল্টন সৈন্য খেতম করে দিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে কয়েকজন পদস্থ অফিসারও রয়েছে। এদিকে বেঈমান পাক-সেনারা এখনও বাংলাদেশে স্বাধীনতাকামীদের ওপর অব্যাহতভাবে নির্যাতন ও নির্বিচারে হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। টাঙ্গাইলে পাক-সৈন্যরা মীর্জাপুর হাসপাতালের প্রায় এক হাজার রােগী তাড়িয়ে দিয়ে হাসপাতাল ভবনটি দখল করে নিয়েছে। হাসপাতাল থেকে বিতাড়িত রােগীদের মধ্যে বেশ কিছুসংখ্যক সন্তান সম্ভবা মহিলাও ছিলেন। হাসপাতাল ভবনটি দখলের সময় ইয়াহিয়ার বর্বর-সৈন্যরা ডাক্তার ও নার্সদের অপমানিত করে এবং তাদের অনেককেই নৃশংসভাবে হত্যা করে। | চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সন্নিহিত অন্যান্য এলাকায় প্রবল বন্যা সৃষ্টির কুমতলব নিয়ে তারা কাপ্তাই-এর কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সব কটি সুইস গেটই বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে হালদা, শখ এবং মাতা মহুরী নদীর জলস্ফীতি বিপদসীমা ছাড়িয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রামের মাহালছড়ি, মায়াণীর মুখ, উরসীর মুখ, রঙ্গীপাড়া প্রভৃতি অঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে বর্ষা ও বৃষ্টির আশঙ্কায় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ম্যানেজার ১৬টির মধ্যে ৪টি গেট খুলে দিয়েছিলেন। পাকসেনারা আবার ঐ ৪টি গেট বন্ধ করে দেয় এবং প্রকল্প ম্যানেজারকে গুলী করে হত্যা করে।

জয়বাংলা (১): ১: ৭।

২৫ জুন ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯ –জয়বাংলা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!