সাবাস, বাংলাদেশ এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
জ্বলে-পুড়ে-মরে ছার খার তবু মাথা নােয়াবার নয়
প্রচণ্ড আঘাতের মুখে পাকসেনা বিপর্যস্ত ২৮শে মে যশাের, মুক্তিফৌজ আর পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের মধ্যে গুলি বিনিময়ে অন্তত ৭ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে ও একটি বাঙ্কার বিধ্বস্ত হয়েছে। মুক্তিফৌজ গত শুক্রবার থেকে মেহেরপুরের মাথাভাঙ্গা নদীর পূর্ব তীরে পাকিস্তানী সৈন্যদের ঘাঁটির উপর আক্রমণ করছে। মুক্তিফৌজের তরফে কেউ হতাহত হন নি। আবেদ আলি নামে একজন মুসলিম লীগ নেতা বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে প্রথম গুপ্তচরের কাজে লিপ্ত ছিল, মুক্তিফৌজের লােকেরা তখন তাকে ধরে ফেলেন। মুক্তিবাহিনীর চোরাগােপ্তা আক্রমণকারীরা গতকাল সন্ধ্যায় মধুমতি নদীর পশ্চিম তীরে একটি গুপ্ত স্থান থেকে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে একজন সুবেদারসহ ৩ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করেন। মুক্তিফৌজের গেরিলারা গতকাল রাত্রে দক্ষিণ-পশ্চিম খণ্ডে চুয়াডাঙ্গা থেকে ১০ কিলােমিটার দূরে মুন্সীগঞ্জের কাছে একটি রেলসেতু উড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে কুষ্টিয়ার দিকে ট্রেণ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে এবং খান সেনাদের রসদ সরবরাহের পথ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। যুদ্ধ আর চাই না বাংলাদেশে সাধারণ স্তরের পাক সেনাদের মনােবল ক্রমেই ভেঙ্গে যাচ্ছে। মুক্তিসেনাদের হাতে বন্দী। আহত একজন পাক সেনা একথা কবুল করেছে। তার মতে, নীচু স্তরের সেনারা যেভাবেই হােক এ। যুদ্ধের শেষ চাইছে। কালীগঞ্জের কাছে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে এই পাক সেনা আহত হয়। তার সঙ্গী ৩ জন পাক সেনা মারা যায়।
আহত মুক্তি সেনানীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে সব ‘সেনানী’ আহত হয়ে কর্মহীন ও অকর্মণ্য। হয়ে পড়েছেন, তাঁদের পরিবারবর্গের পুর্নবাসনের জন্য সমস্ত রকমের ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসন মন্ত্রী জনাব এ, এইচ, এম, কামরুজ্জামান সরকারের কেন্দ্রীয় সাহায্য ও পুনর্বাসন দফতরের এক বার্তায় এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। পাকিস্তানকে সাহায্যদান বন্ধ করুন। বাংলাদেশ মিশনের জনাব আমজাদুল হক আন্তর্জাতিক সংস্থাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ইয়াহিয়া খানের সরকার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যদি মীমাংসার না আসেন, তাহলে যেন তারা পাকিস্তানকে কোন আর্থিক সাহায্য না দেয়। তিনি বলেন, মীমাংসা না হলেও আন্তর্জাতিক সংস্থা যদি পাকিস্তানকে সাহায্য করেন, তাহলে তারা ইয়াহিয়া খানের ফ্যাসিস্ট সরকারের সহায়ক বলে গণ্য হবেন। মীরজাফরের দল হুঁশিয়ার। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিফৌজের কেন্দ্রে কেন্দ্রে খবর আসছে যে, বিভিন্ন স্থানে এক শ্রেণীর মীরজাফর বাংলাদেশ ও বাঙ্গালীর স্বার্থের বিরােধীতা করছে। তারা খুনী ইয়াহিয়া খাঁর লেলিয়ে দেওয়া পাঞ্জাবী কুকুরগুলােকে মুক্তিফৌজের অবস্থান জানিয়ে দিচ্ছে, আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের নেতা ও কর্মীদের নাম ঠিকানা বলে দিচ্ছে অথবা ক্ষেত্র বিশেষে পশ্চিমা সৈন্যদের পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে। তারা নানারকম মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে শত্রু কবলিত এলাকার মানুষের মনােবল ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
গুন্ডা-দুস্কৃতিকারী লেলিয়ে দিয়ে লুটতরাজ করাচ্ছে অথবা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়িয়ে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির প্রয়াস পাচ্ছে। এদের কোন কোন নেতা বেতার বক্তৃতা, সংবাদপত্রে বিবৃতি ও তথাকথিত জনসভা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশে…হুশিয়ার …এরা যদি এই মুহূর্ত থেকে নিজেদের অপকর্ম বন্ধ না করে তাহলে মুক্তিফৌজ তাদেরকে কুকুরের মত। হত্যা করবে। জয় বাংলা। সকলি ফুরায়ে যায় মা… যা আশঙ্কা করা গিয়েছিল তাই ঘটতে শুরু করছে। তবে এত তাড়াতাড়ি ঘটবে তা আমরা ভাবতেও পারিনি। পশ্চিম পাকিস্তানের জনজীবনের উপর পড়তে শুরু করেছে ইয়াহিয়া ভুট্টো-টিক্কা খানের অঘােষিত যুদ্ধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া। শিল্পপতিদের কলকারখানার গুদামে জমে উঠেছে বিপুল পরিমাণ পণ্য। তাদেরকে করতে হয়েছে উৎপাদন হ্রাস। শ্রমিকদের অসহ্য হয়ে উঠেছে বেকারীর জ্বালা। অন্যদিকে জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে শাঁ শাঁ করে। এসবের একমাত্র কারণ যুদ্ধের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানী পণ্যের একমাত্র বাজার বাংলাদেশ আজ হাতছাড়া। পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতি, পুঁজিপতি ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের বাপদাদার খাস তালুক-বাংলাদেশের বাজারে তাদের মাল আজ আর চলছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বন্ধক রেখে বিদেশ থেকে পাকিস্তান সরকার দুহাতে যে সাহায্য, ঋণ, মঞ্জুরী এনে মরুময় পশ্চিম পাকিস্তানকে শস্যশ্যামলা করে তুলেছিলাে আর সেখানে গড়ে তুলেছিলাে শত শত কলকারখানা, সেই ঋণ ও সাহায্যের কিস্তি পরিশােধ করা আজ আর সম্ভব হচ্ছে না। বাংলার পাট, চা বিদেশে রপ্তানী করতে না পারলে কোনদিনও পাকিস্তান সরকার তা পরিশােধ করতে পারবে না। এদিকে বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যার জন্য ইয়াহিয়া সরকারের ব্যয় হচ্ছে দৈনিক এক থেকে দেড় কোটি টাকা। কিন্তু তা আর পাবে কোথায়? বাংলাদেশ থেকে আজ তো আর কোন আয় নেই। অতএব…
স্বাধীন বাংলা (৪) ও সংখ্যা
২৯ মে ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯ —স্বাধীন বাংলা