You dont have javascript enabled! Please enable it!

রণাঙ্গনে

এক সপ্তাহের লড়াইয়ে আরও সহস্রাধিক শত্রু সৈন্য নিহত দেড় মাস আগে ইয়াহিয়া-টিকার জল্লাদবাহিনী সুপরিকল্পতি উপায়ে বাংলাদেশের উপর যে ব্যাপক গণহত্যা শুরু করেছিল, আজ তা এমন এক পর্যায়ে এসেছে যেখানে তারা প্রত্যহ বাংলা মুক্তিবাহিনীর। প্রচণ্ড চাপের ফলে ভীত সন্ত্রস্থ ও নাজেহাল হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন তরুণ মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকফৌজকে দিতে হচ্ছে প্রাণ, দিতে হচ্ছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র গােলাবারুদ। দৃঢ় মনােবল সম্পন্ন, অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত, মৃত্যুঞ্জয়ী আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা সিলেট-কুমিল্লা, চট্টগ্রাম নােয়াখালী, ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল, দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তরবঙ্গ সেক্টরের বিভিন্ন রণাঙ্গনে দিনের পর দিন পাকফৌজের উপর গেরিলা। কৌশলে চোরাগুপ্তা, ঝটিকা কখনাে বা অতর্কিত হামলা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এতে গত এক সপ্তাহে অন্ততঃ আরাে এক সহস্র পাক সৈন্য নিহত হয়েছে। গত ৯ই মে মুক্তিবাহিনী আখাউড়া সাব-সেক্টর এবং বিবিরবাজার এলাকায় পাক-ফেীজের উপর এক অতর্কিত হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ফলে পাকহানাদার বাহিনীর ৩ শত সৈন্যকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। হানাদারবাহিনীর এক কোম্পানী সৈন্য বিবিরবাজার থেকে সােনামুড়া সীমান্তের দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করলে মুক্তিবাহিনী সাফল্যের সাথে তাদের অগ্রাভিযান প্রতিহত করে দেয়। পাক-ফেীজের এ সব সৈন্য ছদ্মবেশের আশ্রয় নেয়। তারা বােরখা পরে মেয়েদের ছদ্মবেশ ধরে, অন্যেরা সার্ট ও পাঞ্জাবী পরে বাঙালী সাজে। কিন্তু এদের ছলচাতুরী গ্রামবাসীদের সজাগ দৃষ্টির সামনে ধরা পড়ে যায়। গ্রামবাসীরা। তাদের ছল বুঝতে পেরে মুক্তিফৌজের সেনারা তৎক্ষণাৎ প্রস্তুত হয়ে যায়। এরপর চল্লো গুলী বিনিময় । মুক্তিফৌজের তীব্র চাপের মুখে ছদ্মবেশী পাক-সেনারা বহু হতাহত সঙ্গীকে ফেলে পিঠটান দেয়।  একই দিনে মুক্তিবাহিনী রংপুর জেলার দুর্গাপুরে থানায় পাক-ফৌজের একটি ঘাটির উপর। আকস্মিক হামলা চালায় গেরিলা কৌশলের আক্রমণে পাক-ফৌজ দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং এলােপাথারী গােলাগুলী ছুড়তে থাকে।

কিন্তু তবুও মুক্তিবাহিনীর অবস্থান নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়। মুক্তিবাহিনীর নির্মম হামলায় পাক-ফৌজের ৬ জন সৈন্যকে প্রাণ হারায়। মুক্তিফৌজ মেহেরপুর উপকণ্ঠে ভৈরব নদীর পূর্বতীরে পাক-হানাদার ঘাটির উপর শেল বর্ষণ। করে। অন্যদিকে ভৈরব নদীর পশ্চিমতীরে মেহেরপুরের একটি গুপ্ত স্থান থেকে মুক্তিবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে একজন সুবেদারসহ বেশ কয়েকজন জল্লাদবাহিনীর সৈন্যকে হত্যা করে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা দক্ষিণমপশ্চিম খন্ডে চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রায় ৭ মাইল দূরে জয়রামপুরের কাছে একটি রেল সেতু উড়িয়ে দিয়েছে। ফলে দর্শনার দিকে ট্রেণ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে এবং পাকবাহিনীর রসদ সরবরাহের পথ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। গত ১০ই মে মুক্তিবাহিনী আখাউড়া সেক্টরে পাক-ফৌজের উপর আকস্মিকভাবে এক বিরাট হামলা চালায়। এই সেক্টরের প্রচণ্ড লড়াইয়ে ৪ শত খানসেনা খতম হয়েছে। এ ছাড়া পাক-ফেীজের  কাছ থেকে মুক্তিবাহিনী একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার হস্তগত করেছে। এদিকে সিলেট জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাটি তেলিয়াপাড় এলাকায় প্রবল বৃষ্টিপাতের মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাক-ফৌজের প্রচণ্ড লড়াই বাধে। তেলিয়াপাড়া চা-বাগানটি পুনর্দখল করার জন্য পাক-ফৌজ প্রচুর গােলাবারুদ নিয়ে মুক্তিবাহিনীর উপর আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী এর সমুচিত জবাব দেয়। এই সংঘর্ষে ১২জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। তাদের মধ্যে দুজন অফিসারও আছে। ইয়াহিয়া-টিক্কার জল্লাদবাহিনী কুমিল্লা জেলার তিতাস গ্যাস প্লান্টটি ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে শিল্প-কারখানাগুলাে অচল হয়ে পড়েছে।

মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সড়কের শুভপুর সেতুতে অবস্থিত হানাদারবাহিনীর উপর এক আকস্মিক হামলা চালিয়ে তাদেরকে দিশেহারা করে তােলে। মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড চাপের মুখে হানাদারবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। উত্তর-পশ্চিম সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে আরও ৬০ জন পাক-ফৌজ নিহত হয়। এছাড়া পাক-ফৌজের ৭টি গাড়ীতে অগ্নি সংযােগ এবং তিনটি বাঙ্কার ধ্বংস করে দেয়া হয়। | মুক্তিবাহিনী গত মঙ্গলবার রংপুর জেলার কোলাঘাট, মােগলহাট ও ওমরখানায় পাক-সেনা ঘাঁটিগুলাের ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ আক্রমণে মােগলহাটে বহু পাক-ফেীজ হতাহত হয়। | দিনাজপুরে মুক্তিবাহিনী পার্বতীপুর-সান্তাহার রেল রুটে এবং পাঁচবিধি ও জয়পুরহাট শহরে পাকফৌজের ঘাঁটিগুলাের ওপর আক্রমণ চালিয়ে সড়ক-রেল যােগযােগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। জয়পুরহাটের সংঘর্ষে ৭জন পাক-হানাদার খতম হয়েছে। মুক্তিফৌজ কমান্ডােরা কুড়িগ্রামে পাক ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালিয়ে পাক-ফৌজের হাতে বন্দী ১২জন মুক্তিসেনাকে ছিনিয়ে আনে। এছাড়া ধরসা ও কুড়িগ্রামের মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু কমান্ডােরা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। গত ১২ই মে মুক্তিবাহিনী কসবা অঞ্চলে পাক-ফৌজের উপর হামলা চালান। মুক্তিবাহিনী এখানে দুমুখী এমন আক্রমণ চালান যে পাক-ফেীজ দিকবিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও পাকফৌজের মধ্যে এই ভয়াবহ আক্রমণে একশত ২৭ জন পাক-ফৌজ নিহত হয়। এদের মধ্যে একজন মেজরও ছিল।

জয়বাংলা (১) ১ : ২;

১৯ মে ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯ –জয়বাংলা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!