বামপন্থা ও বাংলাদেশ বাম ধারার মানুষজন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অসহায় দুঃখী মানুষদের পক্ষে ছিল। কঠিন বা আগ্রাসী বাম বিপক্ষে। মৃদু বামরাতো রাস্তায় নেমেছিল বিভিন্ন দেশে তাদের সীমিত শক্তি নিয়ে এমনকী পুঁজিবাদী দেশগুলিতেও। সে কাহিনি হারিয়ে গেছে বা মূলধারার ইতিহাসে আসেনি। কিন্তু এসব বিবরণী বাদ দিলেতো ইতিহাসও সম্পূর্ণ হয় না। | সোশালিস্ট লেবার লিগের কি আমরা নাম শুনেছি। অধিকাংশই শুনিনি। ব্রিটেনের বামপন্থী একটি ক্ষুদ্র দল। কিন্তু ১৯৭১ সালে ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে তারাই বাংলাদেশের জন্য ছিল সবচেয়ে সোচ্চার। বাংলাদেশের পক্ষে তারা সভা সমাবেশ করেছে নিয়মিত কিন্তু মূলধারার কাগজ বলে যেগুলি পরিচিত সেগুলিতে এসব খবর আসেনি।১৪ এপ্রিল লিগ তাদের মুখপত্র ওয়াকার্স প্রেসে ছোট একটি বিজ্ঞাপন। দেয়Socialist Labour League PUBLIC MEETINGLong live Bangla Desh! Down with Imperialism! Make the Tory Govt. resign!Friday April 18, ৪ p.m. TOYNBEE HALL COMMERCIAL ST. EI. Speaker, M. Bandaসোশালিস্ট লেবার লিগ ১৮ এপ্রিল রাত ৮টায় পূর্ব লন্ডনের টয়েনবি হলে একটি সভা আহ্বান করেছিল। বক্তৃতা দেবেন ওয়াকার্স প্রেসের এম, বান্ডা। তাদের শ্লোগান ছিলবাংলাদেশ চিরজীবী হউক।
সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক!টোরিদের পদত্যাগে বাধ্য কর। ১৮ এপ্রিল রাত আটটায় সভা শুরু হলো। হল কানায় কানায় ভর্তি। ৫০০ বাঙালি শ্রমিক এসেছেন বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানাতে। হলে ঢুকতে না পেরে কয়েক শশা লোক বাইরে অপেক্ষা করছিলেন।ব্রিটেনের শ্রমিক আন্দোলনকে সম্পূর্ণ ভাবে বাংলাদেশ আন্দোলনকে সমর্থনের আহবান জানিয়ে মি, বান্ডা বলেন, বাংলাদেশের সংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে এক বিরাট ধাক্কা। ভারতের ওপর সাম্রাজ্যবাদ যে নড়বড়ে কাঠমো চাপিয়ে দিয়েছিল শ্রমিক কৃষকদের সশ্রামে তা ভেঙে যাবে। মি, বাড়া আরো বলেন, বৃহৎশক্তি এবং জাতিসংঘকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। টোরি সরকারকে লক্ষ্য করে তিনি বলেন, টোরি সরকার থেকে আশা করার কিছু আছে এমন কথা যে বলে সে হয় নির্বোধ নয় মিথ্যাবাদী।| মি, বান্ডা বলেন, ব্রিটিশ এবং বাঙালি শ্রমিকরা একই ধরনের শত্রুর মুখোমুখি। বর্ণবাদের সমস্যা সত্ত্বেও ব্রিটিশ ওয়ার্কিং ক্লাশের উচিত হবে বাংলাদেশকে সমর্থন করা। | চীন এই বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে-ঘোষণা করেন বান্ডা। তিনি বলেন, যে ইয়াহিয়াকে সমর্থন করে সেই শ্রমিক শ্রেণীর শত্রু।সভায় ১লা মের সমাবেশ যাতে বড় হয় সে আহ্বান জানানো হয় কারণ সেই সমাবেশ সমর্থন করবে বাংলাদেশকে। তারপর কিছু প্রস্তাব পাশ করা হয়। প্রস্তাবে সাম্রাজ্যবাদী, চীনা স্টালিনিন্ট ইয়াহিয়া ও টোরি সরকারের নিন্দা করা হয় এবং শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করা হয়। প্রস্তাবে ঘোষণা করা হয়বাঙালিদের একমাত্র বস্তু বিশ্বের শ্রমজীবীরা। মিসেস গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় পুঁজিবাদী ও ভূমি মালিকরা ইয়াহিয়া খানের মতোই বাঙালিদের শত্রু। সাম্রাজ্যবাদ, স্ট্যালিনবাদ, হিন্দু এবং মুসলমান পুঁজিপতি ও সবাইর আকাক্ষা ভারত বিভাগ বহাল রাখা।ওয়াকার্স প্রেস তাদের ২২ তারিখের সংখ্যায় ‘স্টালিনিজম মাওজিম অ্যান্ড বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয় ছাপে। তাতে তাত্ত্বিক অনেক রেটরিক আছে তবে তার দু’একটি একেবারে যে রেটরিক ছিল না তা পরে প্রমাণিত হয়েছে।সম্পাদকীয়ের শুরুতে বলা হয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দুটি স্মৃতিস্তম্ভ পড়া উচিত-একটি বাঙালি শ্রমজীবী ও কৃষকদের বীরত্ব গাথা স্মরণে, অন্যটি আন্তর্জাতিক স্তালিনবাদ বাংলাদেশের প্রতি যে বিশ্বাসঘাতকতা তার স্মরণে, পত্রিকার ভাষায়”One of them will symbolise the pathos and heroism of the Bengali workers and peasants while the other will remind posterity
of the cynicism, hypocrisy and treachery of international Stalinism and its attempts to betray the struggle for Bangladesh.”সম্পাদকীয়তে আরো বলা হয়েছিল, গণতান্ত্রিক ঐক্যের অর্থ বাংলাদেশের। শ্রমজীবীদের সঙ্গে প্রতারণা করা। কারণ এর অর্থ দুর্বল ও দুর্নীতিবাজ বাঙালি বুর্জোয়াদের স্বার্থের কাছে শ্রমজীবীদের স্বার্থ বলি দেয়া। এই বুর্জোয়ারা পাকিস্তানী শত্রুদের থেকে তাদের বাঙালি শ্রমজীবী বন্ধুদের ভয়ংকর মনে করে।সূত্র : Workers Press, 16.4.1971; 19.4.1971; 22.4.1971. লাতিন আমেরিকায়ও মিছিলকতোদূর লাতিন আমেরিকা! কোথায় আর্জেন্টিনা, কোথায় চিলি বা ভেনিজুয়েলা। কিন্তু ১৯৭১ সেখানেও মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছিল। | ভিক্টোরিয়া ওকাম্পাে নামটি আমাদের বিশেষভাবে পরিচিত রবীন্দ্রনাথের কারণে কিন্তু তিনি নিজগুণেই আর্জেন্টিনার বুদ্ধিজীবী মহলে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। বোহের্সের তো এখন বিশ্বজোড়া খ্যাতি স্পেনিশভাষার অন্যতম লেখক হিসেবে। বাঙালির প্রতি ওকাম্পোর দূর্বলতা থাকা অস্বাভাবিক নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাম দিয়েছিলেন বিজয়া। অনুমান করছি আর্জেন্টিনার বুদ্ধিজীবীরা যে বাঙালিদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ভিক্টোরিয়া।১৯৭১ সালের ১১ জুন আর্জেন্টিনার লেখক, অ্যাকাডেমিশিয়ান, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরা মিলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। স্মারক লিপির মূল কথা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে যা চলছে তা অনভিপ্রেত বিশেষ করে ভারতে শরণার্থীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, সুতরাং এর প্রতিকার হওয়াউচিত।তারা লিখেছিলেন মানবতার দুর্দশা স্থানীয় নয়, এটি সমগ্র মানবজাতির আশঙ্কা।কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে যা হচ্ছে তাতে মানবতা জাগ্রত হচ্ছে বলে মনে হয় না। তাদের ভাষায়- Human tragedy should know no national barriers; suffering, death and destitution any where in the world should be concern of entire humanity. Yet it is unfortunate that international! conscience does not seem to have awakened sufficiently to the happenings in East Bengal.” | স্মারকলিপিটির অনুবাদ পূর্ব বাংলার সাম্প্রতিক ট্র্যাজিক ঘটনায় অবিশ্বাস্যসংখ্যক মানুষ পুরুষ, মহিলা ও শিশু নিজ দেশ ছেড়ে পালিয়ে প্রতিবেশি দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ মানবিক সমস্যা। ঐতিহ্যের প্রতি অনুরক্ত থেকে ভারত শান্তি, সহাবস্থান ও সমমর্মিতার প্রতি নিবেদিত- হতভাগ্য শরণার্থী, যাদের সংখ্যা ৪০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে, তাদের খাওয়াতে-পরতে ও বাসস্থান দিতে ভারত হিমশিম খাচ্ছে। ভারত যখন নিজেই জাতি গঠনের কাজে নিয়োজিত, তখন এই বিপুলসংখ্যক মানুষের ভার একা বহন করা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষের ট্রাজেডি জাতীয়তা ও সীমান্তের বাধা মানে না; পৃথিবীর যেকোনো স্থানে ভোগান্তি, মৃত্যু ও বিপন্নতা সমগ্র মানবজাতির উদ্বেগের কারণ। তার পরও এটা দুর্ভাগ্যজনক যে পূর্ব বাংলায় যা ঘটছে, তার পরও বিশ্ববিবেক ঠিকভাবে জেগে ওঠেনি। এমনকি অন্য দেশের দায়ভার, যার সৃষ্টিতে ভারতের কোনো ভূমিকা নেই, তা প্রশাসনের মাধ্যমে মানবিক সমস্যা কমাতে পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক সাড়া পাওয়া যায়নি। সরকারগুলোর কিছু সাহায্য-তহবিল থেকে থাকে, কিন্তু সংকটের যে আকার, তাতে পরিস্থিতির দাবি-বিশ্বমানবতা এগিয়ে আসুক, এ সমস্যার ভার বহনে অংশী হেকি। এটি আন্তর্জাতিক সমস্যা, জাতীয় নয়।‘এই বিশেষ ক্ষেত্রে জনাব কিন্তু তাত্ত্বিকভাবে একাত্মতা ঘোষণা করা নয়, কিংবা কেবল অনুধাবনের সাক্ষ্য নয়, এটা হতে হবে ধনাত্মক ও সরাসরি সাহায্য হতে হবে নগদ সাহায্য কিংবা দ্রব্যসামগ্রী সেই সঙ্গে বিশ্ববিবেক জাগানো এবং এই সংকটকে সমষ্টিগত দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করা তো রয়েছেই। আশা করা যায়, আমাদের সরকার বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও সংহতির প্রতি বিশ্বস্ত থেকে পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী জরুরি ভিত্তিতে সর্বোচ্চ সাড়া দেবে এবং ভারতের ওপর আরোপিত দুর্দশা লাঘব করবে।’ | যারা স্বাক্ষর করেছিলেন তাদের নামের পুরো তালিকা পাওয়া যায়নি তবে ভেনিজুয়েলার এক রিপোর্ট থেকে কিছু নাম পাওয়া যায় তা পরে উল্লেখ্য এখানে যে তিনজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা হলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পাে, জর্জ লুই বোহের্স এবং রেভারেন্ড ফাদার ইসমায়েল কুইলেস।তার পর পরই ২৪ জুন ভেনিজুয়েলার কাউন্সিল ফর ওয়ার্ল্ড পিস এ্যাণ্ড হিউমান রাইটস ‘এক কড়া বিবৃতি প্রদান করে। সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেল ড, রিকার্ডো মোলিনা মার্টি কঠোর ভাষায় পাকিস্তানীদের নিন্দা করেন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালানোর জন্য। তার ভাষায় পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল ও সমরবিদরা চারদিকে তাদের ফ্যাসিস্ট বাহিনী পাঠিয়ে গণহত্যা চালাচ্ছে।| জুলাই ১৪ তারিখে ভেনিজুয়েলার ল্য রিলিজিয়ন পত্রিকার খবরে জানা যায়, ঐ দেশের ২৯ জন বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী পূর্বপাকিস্তানে মানবতার বিপর্যয়ের অবসান জানিয়েছেন, তারা ভারতকে সবধরনের সাহায্যের জন্য আবেদন করেন।বিবৃতিতে তারা বলেন, আর্জেন্টিনায় ইতোমধ্যে তাদের সহযোগীরা এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাঁরা আর্জেন্টিনার যাদের নাম উল্লেখ করেন।
তাঁরা হলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পাে, জর্জ লুই বোহের্স, এডােয়ার্ডো মালিয়া, আর্নেবেটা সাবাতো, ফিডা সুকৎজ দ্যা মন্টোনি হেকটর বাসালদুয়া, এডেলফো দ্য ওবিয়িত প্রমুখ, বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় ভেনিজুয়েলার কার্ডিনাল হোসে মেৰার্তো কুইনটেরোর কথা যিনি ইতোমধ্যে বাঙালিদের জন্য উচ্চকণ্ঠে আবেদন জানাচ্ছিলেন, পত্রিকার ভাষায়, “…Quintero has already raised his vibrant voice…”,সু : Bangladesh Docies. vol: 2.
মসিয়ে প্রেম্য যা করলেন।১৯৭১ সালে অনেক ত্রাণ সংস্থা এগিয়ে এসেছিল বাঙালি বিশেষ করে বাঙালি শরণার্থীদের সাহায্যে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রেডক্রস। | এপ্রিলের একেবারে শুরুতে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি বাংলাদেশে ত্রাণ কাজের জন্য একটি দল পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। তারা মেডিকেল সাপ্লাই নিয়ে করাচীর পথে রওয়ানা হয়ে যায়। কিন্তু, পাকিস্তান সরকার তাদের করাচিতেই আটকে দেয়। কমিটির সহ সভাপতি ৫৯ বছরের এম, জ্যাক শ্ৰেম্য মনে করেন, প্রকাশ্য ঘোষণা না দিয়ে যদি দলটি এাণ কাজে যেত তাহলে হয়ত পাকিস্তান বাধা দিত না। | মসিয়ে প্রেম্য ছিলেন জেনিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক স্টাডিজের পরিচালক। রেডক্রসের কিছু নীতি নিয়ে এর আগেও তার সঙ্গে বিরোধ হয়েছে। তার ধারণা তার মতামত গ্রহণ না করার জন্যই পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ যেতে পারল না। সুতরাং, এর প্রতিবাদে তিনি সহসভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন।সূত্র : Daily Telegraph, 6.4.1971