You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.11 | হুঁশিয়ার! ইয়াহিয়া-টিক্কা হুঁশিয়ার - সংগ্রামের নোটবুক

হুঁশিয়ার! ইয়াহিয়া-টিক্কা হুঁশিয়ার

সারা বাঙলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ মুক্তিসংগ্রামের জয় পতাকা হাতে নিয়ে যুদ্ধ করছেন পশ্চিম পাকিস্তানী দস্যু ইয়াহিয়া জঙ্গীজোটের বর্বর সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে। বাঙলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত-উত্তরে সিলেট সীমান্ত থেকে শুরু করে দক্ষিণের টেকনাফ পর্যন্ত বাঙলার সাধারণ মানুষ-কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতা মরণপণ করে রুখে দাঁড়িয়েছেন নরখাদক দস্যু সৈন্যের মুকাবিলা করতে । আজকের এই যুদ্ধ বাঙালীর মুক্তির যুদ্ধ। এই যুদ্ধ বাঙলার গণযুদ্ধ। পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও ভাড়াটে লম্পটবাহিনী গণ-মানুষের জীবন-সংগ্রামের ঢেউকে প্রতিহত করতে পারেনি। বাঙলার মাটিতেও পশ্চিম পাকিস্তানী হামলাদাররা মুক্তিফৌজের সম্মিলিত মহান প্রচেষ্টার সামনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেই। এই কথা সুনিশ্চিতভাবে জেনেই আমাদের গণযােদ্ধারা আজ বাঙলার গ্রামে গ্রামে, শহরে, বন্দরে মরণপণ করে নেমেছেন স্বাধীনতার যুদ্ধে। বাঙলার মানুষের কাছে জল্লাদ ইয়াহিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা ক্ষমার অপেক্ষা রাখে না। ঢাকায় মিথ্যা স্তোক্যের বৈঠক বসিয়ে সবার অগােচরে বাঙালীর বুকে ছুরি বসাবার ষড়যন্ত্র ইয়াহিয়া অনেক আগে থেকেই নিয়ে ছিল। সেইজন্যেই সে “বুচার অব্‌ বেলুচিস্তান টিক্কা খাঁকে বাঙলাদেশে পাঠিয়েছিল নৃশংস আক্রমণের জন্যে প্রস্তুতি নেবার জন্যে। পঁচিশে মার্চ তারিখে প্রকাশ্য বৈঠক চলা থাকতে থাকতেই দস্যু ইয়াহিয়া তার ঘৃণ্য অনুচর টিক্কা খাঁকে আক্রমণ শুরু করার আদেশ দিয়ে কাউকে না জানিয়ে ঢাকা ত্যাগ করে চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। রাতের অন্ধকারে টিক্কা তার মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে ঢাকার নিরস্ত্র জনতার ওপর । প্রথম ছত্রিশ ঘন্টার মধ্যেই একমাত্র ঢাকা ও শহরতলী অঞ্চলে টিক্কার দস্যুরা পঞ্চাশ হাজার নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করে নৃশংসভাবে। দুনিয়ার ইতিহাসে খুঁজে দেখুন, এমন বিশ্বাসঘাতকতার নজীর আর কোথাও নেই। থার্ড রাইখের নাৎসী নরপশুদের হত্যালীলাকেও বাংলার ওপর এই দুর্বিনীত অত্যাচারের সত্য কাহিনী স্নান করে দিয়েছে।

ইয়াহিয়া-টিকা-ভুট্টো প্রভৃতি জল্লাদজোট ঠিক করেছিল তারা বাঙালীর জাতীয় অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দেবে। দেশের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সংগ্রামী কৃষক-শ্রমিক-জনতাকে মেরে ফেলে সারা বাঙলাদেশকে মৃত্যু, দুর্ভিক্ষ আর মহামারীর করাল ছায়ায় ঢেকে দেবে। আর সেই গােরস্তানের ওপর রাজত্ব করবে পশ্চিম পাকিস্তানী দুবৃত্ত সরকার। | কিন্তু স্বাধীনতার ঐতিহ্যবাহী বাংলার জাগ্রত জনতা ইয়াহিয়া ও তার কুত্তাদের এই জঘন্য ষড়যন্ত্রকে সম্পূর্ণ বানচাল করে দিয়েছে। ঈশা খাঁ-তীতু মীর সূর্য সেনের ঐতিহ্যবাহী বাঙালী আজ গণসংগ্রামের মুখে এগিয়ে গেছেন দেশকে দুবৃত্তদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য। ঢাকায় সংগ্রামী শ্রমিকের মুখে শুনেছিলাম এক বজ্রশপথের কথা। “টিক্কার ফাসী হবে” সাধারণ শ্রমিকের মুখে সারা বাঙলাদেশের যুদ্ধরত মানুষের রক্তশপথ যেন প্রতিধ্বনিত হল। আজ যারা বাঙলাদেশের ওপর অত্যাচার, লুণ্ঠন আর হত্যার ধ্বংসলীলা চাপিয়ে দিয়েছে, সেইসব। হত্যাকারীদের ইয়াহিয়া টিকা জোটের নরপশুদের হাজির করা হবে বাঙলাদেশের গণআদালতে তাদের যুদ্ধ-অপরাধের জন্য শাস্তি গ্রহণ করতে। বাঙলার মাটিতে সােনা ফলে। কিন্তু আজ সেই মাটি মেহনতী বাঙালীর রক্তে সিক্ত। এই মাটি। সেই শ্যামল ধানের ক্ষেত, পলির প্রান্তর-থেকেই জন্ম নিয়েছে লক্ষ লক্ষ মুক্তিযােদ্ধার । মেঘনা-যমুনাপদ্মার কৃষক, মাঝি, কামার, কুমাের, জোলা ক্ষেত-মজুর হাতে তুলে নিয়েছে মারণাস্ত্র । এঁদের বুকে। জ্বলে উঠেছে স্বাধীনতার অনিবণি আগুন। আমার সকিনা না, আমিনা বােনের ইজ্জত যারা কেড়েছে,  তাদের ক্ষমা নেই। আর ক্ষমা নেই আমার ভাই-এর ঘরে যে দস্যু আগুন দিয়েছে, যে তার ক্ষেত পুড়িয়েছে, তার শিশুকে হত্যা করেছে, তার। সারা বাঙলাদেশে আজ শুধু এক আওয়াজ। ক্ষেত-প্রান্তর-হাট-মাঠ ছাপিয়ে আজ মহাবজ্রধ্বনির মত বীর জনতার কণ্ঠে একই আওয়াজ-“হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার! ইয়াইয়া-টিক্কা হুঁশিয়ার! বাঙলাদেশের স্বাধীনতা তােমরা রুখতে পারবে না।” জয় স্বাধীন বাঙলা।

জয়বাংলা (১) : ১:১ ১১ মে ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯- জয়বাংলা