মান্ধাতা আমলের যন্ত্রপাতি দিয়েই শত্রুপক্ষের হাই ফ্রিকোয়েন্সি (HF) ও ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি (VHF) সিগন্যাল নেটওয়র্ক ইন্টারসেপ্ট করেছিলো ভারতীয় বাহিনী
পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিন্যাস সম্পর্কে কোনাে ধারণা করতে না পারার ফলে আমরা তাদের যুদ্ধের পরিকল্পনা সম্পর্কে কোনাে ধারণা করতে পারছিলাম না। কলম্বাে হয়ে আরাে সৈন্য আসছিল, কিন্তু আমরা তার ধরন বা পরিমাণ সম্পর্কে কোনাে ধারণাই করতে পারছিলাম না। ১৯৭১-এর এপ্রিল/মে মাস নাগাদ আর্মি হেডকোয়ার্টার্সের মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের ডিরেক্টরকে এটা আমি জানাই এবং সেই সাথে পূর্বাঞ্চলের সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসমূহের নিয়ন্ত্রণভার আমাদের ওপরে ন্যস্ত করার দাবি জানাই । উত্তরে তিনি বলেন যে, তাদের সংগৃহীত খবরের কাঁচামাল প্রক্রিয়াজাত করার মতাে প্রয়ােজনীয় দক্ষতা কম্যান্ড হেডকোয়ার্টার্সের নেই বলে সংগৃহীত তথ্যাদি তাঁর দিল্লীস্থ হেডকোয়ার্টার্সে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে তা থেকে আমাদের জন্য প্রয়ােজনীয় অংশটুকুই শুধু আমাদেরকে পাঠাবেন। এ এক অসম্ভব অবস্থা! এর ফলশ্রুতিতে ধরা-পড়া সিগন্যালগুলাে নিয়ে আমাদের কিছু করার না থাকলে অথবা আমাদের নজরে না এলে শুধু যুদ্ধের প্রস্তুতির সময়েই নয়, বরং যুদ্ধ চলাকালীনও – যখন প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত দ্রুত, তখনও – আমরা কার্যকরভাবে কাজ করতে পারিনি। এর পর আমি কথা বলি জেনারেল মানেকশ’র সাথে এবং তাকে প্রতিশ্রুতি দিই যে, সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্সের নিয়ন্ত্রণভার আমাদের ওপরে ন্যস্ত হলে প্রতিটি ইন্টারসেপ্টের কপি তার মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের ডিরেক্টরের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে। সংশ্লিষ্ট প্রয়ােজনীয় তথ্য আমরা অন্য বাহিনীগুলােতেও পাঠাতে পারি । মানেকশ’ এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে প্রয়ােজনীয় অর্ডার ইস্যু করেন। এর ফলে ইস্টার্ন কম্যান্ড-ই একমাত্র কম্যান্ডে রূপান্তরিত হয়, সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্সকে সরাসরি যার অধীনে রাখা হয়। এতে করে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানিদের অবস্থান ও হাল-হকিকত এবং তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছিলাম। পরবর্তীতে অপারেশনের সময়েও এই ব্যবস্থা আমাদেরকে পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুযায়ী দ্রুত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নতুন পদক্ষেপ গ্রহণে সাহায্য করে। আমরা এমনকি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সংঘটিত বেতার যােগাযােগও ইন্টারসেপ্ট করতে সক্ষম হই। আমাদের মান্ধাতা আমলের যন্ত্রপাতি দিয়েও আমরা শত্রুপক্ষের হাই ফ্রিকোয়েন্সি (HF) ও ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি (VHF) সিগন্যাল নেটওয়র্ক ইন্টারসেপ্ট করেছি। আমাদের দিক-নির্দেশনার যন্ত্রপাতি সেকেলে হওয়াতে অবশ্য এলাকার সঠিক অবস্থান সব সময় বুঝতে পারিনি। ইন্টারসেপ্টিং স্টেশনগুলাে আমরা পুনর্বিন্যস্ত করি এবং প্রাপ্ত তথ্যাদি ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে একটি যােগাযােগ নেটওয়র্ক তৈরি করি। সিগন্যাল হেডকোয়ার্টার্স থেকে আমার অফিস পর্যন্ত সরাসরি টেলিফোন যােগাযােগ স্থাপিত হয়। এই সংস্থার কম্যান্ডিং অফিসার লেফটন্যান্ট কর্নেল পি সি ভল্ল (P C Bhalla)-কে প্রয়ােজনে সরাসরি আমার সাথে যােগাযােগ করার অধিকার দেয়া হয়। কোড ব্রেকিংয়ে আমাদের সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা ছিল। জটিল আর্মি কোডের ব্যাপারে তাদের সাফল্যের হার খুব কম হলেও ন্যাভাল কোড ব্রেকিংয়ে অবশ্য তারা যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখায়। বিমান মােতায়েন অথবা গানবােট চলাচল-সংক্রান্ত কোনাে সিগন্যাল ইন্টারসেপ্ট করতে পারলে তৃরিৎ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তা সঙ্গে সঙ্গে আমরা ফোর্ট উইলিয়ামের অ্যাডভান্সড এয়ার হেডকোয়ার্টার্সে জানিয়ে দিতাম। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ের একটা ইন্টারসেন্টের কথা আমার মনে পড়ছে। মেঘনা নদীর গুপ্ত মােহনা (Gupta Crossing)-তে নৌযান একত্র করার একটা ইঙ্গিত এতে ছিল। স্বাভাবিকভাবেই এটা দিল্লীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। জেনারেল মানেকশ’ এটার অর্থ করেন, পাকিস্তানিরা সমুদ্রপথে বার্মা যাবার চিন্তা করছে। শুধু তাই নয়, তাদের পরিকল্পনা যে তিনি ধরতে পেরেছেন, সেটা তাদেরকে জানিয়ে দেবার জন্যও আমাদেরকে নির্দেশ দেন। ডিরেক্টর অভ মিলিটারি অপারেশনস মেজর জেনারেল ইন্দর গিল (Inder Gill)-এর সাথে আমি কথা বলি এবং তাকে জানাই যে, পাকিস্তানিদের সমুদ্রপথে বার্মা যাবার ব্যাপারটির মধ্যে না আছে কোনাে বিশ্বাসযােগ্যতা, না আছে কোনাে গােয়েন্দা-সমর্থন। তাছাড়া এগুলাে ছিল নদীপথের উপযােগী নৌযান, সমুদ্রযান নয়। ইন্দরকে আমি আরাে জানাই যে, এই বক্তব্য সম্প্রচার করা হলে পাকিস্তানিরা কোড বদলে। ফেলবে এবং আমাদের কোড ব্রেকারদের সমস্ত পরিশ্রম বৃথা যাবে; তখন আর কিছুই করার থাকবে না। ইন্দর আমার সাথে একমত হন এবং কথা দেন যে, জেনারেল মানেকশ’র সাথে এ ব্যাপারে তিনি কথা বলবেন। পরে আবার আমাকে ফোন করে তিনি জানান যে, স্যাম কোনাে যুক্তি মানতে নারাজ এবং তার বক্তব্য যাতে সম্প্রচার করা হয়, সেটার ওপরে তিনি বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছেন। শেষ পর্যন্ত স্যামের বক্তব্য প্রচার করা হয় এবং ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানিরা তাদের ন্যাভাল কোড বদলে ফেলে। বলা বাহুল্য, পরবর্তীতে আমরা তাদের আর কোনাে ন্যাভাল ট্রাফিকের মর্মোদ্ধার করতে সমর্থ হইনি। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বেতার যােগাযােগও আমরা ইন্টারসেপ্ট করতে পারতাম। ১৯৭১-এর ১ ডিসেম্বর আমরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানাে একটি মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করি। বঙ্গোপসাগরে কোনাে পাকিস্তানি বাণিজ্যজাহাজ যাতে প্রবেশ না করে, সে ব্যাপারে তাদেরকে এতে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার্সসমূহে এটা এবং সেই সাথে ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি কোনাে বেসামরিক বিমান না আসার জন্য আরেকটি হুঁশিয়ারি-সম্বলিত ইন্টারসেপ্ট আমরা পাঠিয়ে দিই। এসব ইন্টারসেপ্টের মর্মার্থ বিশ্লেষণ করে আমাদের বােঝা উচিত ছিল যে, ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা আমাদের বিমানঘাঁটিগুলােতে বােমাবর্ষণ করবে। শ্রীলঙ্কার নিকটবর্তী এলাকায় অবস্থিত গাজী (Ghazi) সাবমেরিন থেকে পাঠানাে তার বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ-সংক্রান্ত সিগন্যালও আমরা ইন্টারসেপ্ট করি। দিল্লী ও বিশাখাপত্তনমে নৌবাহিনীর কাছে এসব আমরা যথারীতি পাঠিয়ে দিই।
Reference:
Surrender at Dacca: Birth of a Nation | J F R Jacob
সংগ্রামের নোটবুক