You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.29 | অত্যাচারের সব তথ্য - সংগ্রামের নোটবুক

অত্যাচারের সব তথ্য

তাহাদিগকে নিদারুণ এক নির্বাসনের দুর্ভাগ্য হইতে উদ্ধার করিয়া সমাজের শ্রদ্ধায় ও স্বগৃহের সমাদরে পুনর্বাসিত করিতে হইবে। ঢাকার সংবাদে প্রকাশ, রেডক্রস মুক্তিবাহিনী ও জনসাধারণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের একাধিক স্থানের কয়েকটি গৃহ হইতে বহুসংখ্যক নারীকে উদ্ধার করা হইয়াছে। ইহারা পাকিস্তানী সৈন্য ও সামরিক অফিসারদিগের লালসার শিকার হইয়া এই সব গৃহে অবরুদ্ধ অবস্থায় কালাতিপাত করিয়াছেন। ইহাদের মধ্যে শিক্ষিতা ও নিরক্ষরা নারী আছেন। সকলেই বাঙালী নারী, মুসলিম ও অমুসলিম । জননী জায়া ও দুহিতা, সকলেই আছেন। অর্থাৎ বিবাহিতা ও অবিবাহিতা নারী আছেন। পাকিস্তানী সৈনিক ও সামরিক অফিসারের হীন-শােণিতের লালসা বস্তুত সরীসৃপ হইয়া ইহাদিগকে দংশনে দংশনে ক্ষতবিক্ষত করিয়াছে। প্রত্যেক জনপদের বিগত কয়েক মাসের দুর্ভাগাহত জীবনে এ ধরনের নির্যাতিতা নারীদের বহু শিবির অপমানিত নারীত্বের আর্তনাদে ও দীর্ঘশ্বাসে ভরিয়া গিয়াছিল। বাংকারের নিভৃতেও এ ধরনের ধর্ষণামােদের আস্তানার নিদর্শন দেখিতে পাওয়া গিয়াছে। পাক সৈনিক ও সামরিক অফিসারের নৃশংসতা যে হিংস্র জানােয়ারের নৃশংসর চেয়েও নিকৃষ্ট, তাহার পরিচয়ও তাহারা মিত্রবাহিনীর লাথির কাছে লুটাইয়া পড়িবার পূর্বক্ষণে, অর্থাৎ আত্মসমর্পণের প্রাক্কালে প্রদান করিয়াছে। পাকিস্তানী সামরিক পশুগুলি ধরা দিবার আগে এ ধরনের বহু বন্দিনী নারীকে হত্যা করিয়াছে। বিশ্বের ইতিহাসে আক্রমণকারীর অত্যাচারে নারী ও নারীত্বের এ ধরনের ভয়াল ও বিপুল নিগ্রহ ইতিপূর্বে কোনদিন কোন দেশে ঘটে নাই। বিংশ শতাব্দীতে পাকিস্তান নামক এক রাষ্ট্রের সৈন্যবাহিনী নিরস্ত্র-নিরীহকে হত্যা করিতে এবং নারী ধর্ষণ করিতে যে কৃতিত্ব (?) দেখাইয়াছে, তাহাতে আন্তর্জাতিক বিচার ও বিবেকের পক্ষে এই পাক-বাহিনীকে অবশ্যই চরম পশুত্বের ধ্বজা প্রদান করা উচিত।

মানবতার বিরুদ্ধে কত বড় ঘাতকতার কাজ করিয়াছে পাকিস্তানী বাহিনী তাহা সমগ্র বিশ্বের সভ্য মানবসমাজের জ্ঞাত হওয়া প্রয়ােজন। ঘটনার তথ্য যতই প্রকাশিত ও প্রচারিত হইবে, বিশ্বের মানবতা ততই সতর্ক হইবার প্রয়ােজন বেশী করিয়া বুঝিবার সুযােগ পাইবে। ইহাতে শুধু বাংলাদেশের জনজীবনের আত্মসম্মানের চেতনাকে নহে, শুধু অসাম্প্রদায়িক আদর্শকে নহে, পাকিস্তানের সাধারণ নর-নারীর বিচারবুদ্ধিকেও পরিশুদ্ধ করিতে সাহায্য করা হইবে। কেহ যদি মনে করেন যে, পাকিস্তানী বাহিনীর নৃশংসতা ও নারীনিগ্রহের নিদারুণ বাস্তবতার সব তথ্য নীরব হইয়া থাকুক, তবে তাহা পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতাকে  স্নেহাঞ্চল দিয়া ঢাকিয়া রাখিবার ব্যাপার ছাড়া আর কিছু হইবে না। উহারা বাংলাদেশে মানুষের সত্যকে ব্যথিত নিগৃহীত ও শােণিতাক্ত করিয়াছে। উহারা (কিংবা ওরা) বলিতে শুধু উহাদিকগেই বুঝায়, হত্যায় নারীধর্ষণে ও লুণ্ঠনে আত্মনিযুক্ত পাকিস্তানী সৈনিক। উহারা বলিতে কোন্ সম্প্রদায়কে বুঝায় না, কোন দেশের জনসমাজকেও বুঝায় না! শুধু অত্যাচারীকেই বুঝায় এবং অত্যাচারীর অত্যাচারের তথ্য বিবৃত হইতে দেখিয়া বিশেষ অখুশী হইয়া পড়িবার ব্যাপারটা নিশ্চয় অসাম্প্রদায়িকতার কিংবা সাধারণ মানবতার ব্যাপার হইতে পারে না।

২৯ ডিসেম্বর ‘৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা