মুজিবনগর হইতে ঢাকায়
অজ্ঞাতবাস হইতে নায়কেরা ঘরে ফিরিয়াছেন। ঢাকা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন রাজধানী ঢাকা আনন্দ আর উত্তেজনায় অধীর। যুগে যুগে অনেক ঘটনার মৌন সাক্ষী বুড়িগঙ্গা তীরের এই প্রবীণ নগরী কিন্তু একটি স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রের রাজধানী হওয়ার গৌরব এই তার জীবনে প্রথম। উত্তেজনা সেদিনই চরমে উঠিয়াছিল মুক্তিবাহিনী আর মিত্রবাহিনী যেদিন ঢাকায় বাংলাদেশের জয়পতাকা উড়াইয়াছিলেন। কিন্তু তাৎপর্যে এই মুহূর্তটি তুলনাহীন। কেননা, জনতার জয়ধ্বনির মধ্যে তেজগাঁও বিমান বন্দরে যাহারা অবতরণ করিয়াছেন তাহারা রাষ্ট্র-পুরুষ, স্বাধীন বাংলাদেশের ভাগ্য তাঁহাদের হাতে। ইহার পর ঢাকা তথা । বাংলাদেশের জীবনে পরম লগ্ন আর একটিই আসিতে পারে,-বাংলাদেশের নয়নমণি, গণপ্রজাতন্ত্রী। বাংলাদেশের হৃদয়ের রাজা মুজিবর যেদিন তাহার জননীর কোলে ফিরিয়া আসিবেন। আপাতত তাহার আসন। শূন্য। ভারতের মতাে সিংহাসন আগলাইয়া আছেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শ্রীনজরুল ইসলাম আর তাহার সহযােদ্ধারা। বাংলাদেশের মানুষের চোখে তাহারাই আজ মুজিবরের মহান প্রতিজ্ঞার স্মারক। মুজিবনগর । হইতে বিজয়ীর বেশে তাহাদের ঢাকায় প্রত্যাবর্তন অতএব ঐতিহাসিক ঘটনা। ঢাকা-ই অতঃপর মুজিবনগর। আনুষ্ঠানিক নামকরণ যেদিনই হােক, যেখানেই বাংলাদেশ সরকার, মুজিবনগর সেখানেই। বিশ্ব জানিয়াছে । নবজাত জাতির কান্ডারীরা এখন তাহাদের আপন রাজধানীতে। নায়কেরা যে পথে ফিরিয়াছেন সে পথ কুসুমাস্তীর্ণ নহে, লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা। আনন্দক্ষণে। অতএব অযুত চোখে অশ্রুত ঝরিবে। কিন্তু উপায় কী? স্বাধীনতা এই পরম মূল্যই চাহে। সেই দাবি মিটাইতে যাহারা অন্ধকার রজনীতে ক্ষুরধার পথে নিরুদ্দেশ যাত্রা করিয়াছিলেন তাহারা যুগাযুগান্তরের মুক্তিযােদ্ধাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়াছেন মাত্র। স্বাধীনতার জন্য ক্ষ্যাপার মতাে দেশে দেশে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছেন। ইতিহাসের আরও অনেক নায়ক। সিদ্ধি সকলের ভাগ্যে জোটে নাই, প্রবাসেই দৈবের বশে অনেকের জীবতারা খসিয়াছে।
এই নেতৃত্বের কৃতিত্ব এই প্রবাসে চরম দুঃখকষ্টের মধ্যেও তাহারা একদিনের জন্য নিজেদের প্রতিজ্ঞা বিস্মৃত হন নাই । তাঁহারা সঠিক মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন, একাগ্র নিষ্ঠায় নানা । রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করিয়াছেন। জাতীয় ঐক্যের প্রতীক তাহারা, সাড়ে সাত কোটি মানুষের সংগ্রামী। প্রতিভূ মুজিবনগরের আম্রকানন হইতে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা-দীর্ঘ নয় মাসে প্রতি পদক্ষেপে এই নেতৃত্ব জানাইয়াছেন, মুজিবের যােগ্য সহযােদ্ধা তাহারা। | স্বাধীনতার পরে আজ তাহাদের সামনে অনেক কাজ। অফুরন্ত। প্রথম কর্তব্য রক্তাক্ত বাংলাদেশে। আইন-শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠা। যুদ্ধে যাহারা ছিলেন সুশৃঙ্খল যুদ্ধ শেষে তাঁহারা ছিলেন সুশৃঙ্খল, যুদ্ধ শেষে তাহারা। বিশৃঙ্খলা বরদাস্ত করিবেন-এটা অবিশ্বাস্য। উত্তেজনার অনেক কারণ আছে, বিশ্বাসঘাতক এবং বিশুদ্ধ। ঘাতক-সকলকেই অবশ্য প্রাপ্য মিটাইয়া দিতে হইবে। কিন্তু সেটা করিতে হইবে আইন-নির্দিষ্ট পথে। স্বাধীনতার এটা অন্যতম প্রধান শর্ত। প্রতিপক্ষ বর্বরতার নূতন নজির স্থাপন করিয়াছে বলিয়াই বিজয়ী। পক্ষকে আরও সতর্কতার সঙ্গে পা বাড়াইতে হইবে; সমগ্র দুনিয়া সাগ্রহে তাহাদের দিকে তাকাইয়া আছেন। পদস্খলন ঘটিলে তাহাদের মধ্যে অনেকে অবশ্যই অতিশয় প্রীত হইবেন। তা ছাড়া রহিয়াছে দেশী বিদেশী। নানা চক্র, স্বপ্ন যখন বাস্তবে পরিণত তখনও তাহারা অবশ্যই নৈরাজ্যের উপাসক। একমাত্র শান্তি আর। আইনের শাসনই পারে তাহাদের মতলবকে ব্যর্থ করিয়া দিতে। মনে রাখিতে হইবে প্রায় এক কোটি শরণার্থী। পা বাড়াইয়া আছেন। তাহারা যেন থমকিয়া না দাঁড়ান। প্রায় কুড়ি লক্ষ অবাঙালী নাগরিক নাকি আবার ভারতে শরণার্থী হইয়া আসিতে চাহেন। প্রমাণ করিয়া দিতে হইবে তাহাদের আশঙ্কা সম্পূর্ণ অমূলক, স্বাধীন। বাংলাদেশের সরকার সকলকে লইয়াই সােনার বাংলা গড়িতে চাহেন। শরণার্থী’ শব্দটি চিরকালের মতাে।
এই অঞ্চল হইতে দূর হােক-মধ্যযুগীয় অন্ধতা যেন আর কোনও দিন কাহাকেও ছিন্নমূল করিতে না পারে। এই পাপ-চক্রে এবার স্থায়ী ছেদ প্রয়ােজন। ইতিমধ্যেই লক্ষাধিক শরণার্থী ঘরে ফিরিয়াছেন কিন্তু অসংখ্য এখনও পূনর্বাসনের অপেক্ষায়। যাত্রা। আবার শুরু হইবে নববর্ষের প্রথম দিনে নির্ঘণ্ট অনুযায়ী কথা। সেজন্য ব্যাপক প্রস্তুতিও চলিয়াছে। কিন্তু বলা। নিষ্প্রয়ােজন সে এক দুরূহ ব্রত। বিশ্বের ইতিহাসে যেমন একসঙ্গে এত মানুষের ঘর ছাড়ার কোনও কাহিনী। নাই, একসঙ্গে এত মানুষের ঘরে ফেরার কাহিনীও নাই। ভারত এবং বাংলাদেশ সরকার ছাড়াও অন্যদের সহযােগিতা গ্রহণ জরুরী হইতে পারে। তা ছাড়া পূনর্বাসন অর্থ নিছক হারানাে ঠিকানা খুঁজিয়া বাহির করা। নয়,-পূনর্বাসন, সর্বার্থে স্বাভাবিক জীবনে প্রতিষ্ঠা। সেদিক হইতে বিচার করিলে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষই আজ পূনর্বাসনের অপেক্ষায়। তাঁহাদের ঘর চাই, রুজি রােজগারের পথ চাই। এ সময়ে নির্বাচন ইত্যাদি লইয়া মাতামাতি শুধু অস্বাভাবিক নহে, বােধহয় অশােভনও। এই বিষ অবসন্ন জাতির সামনে আপাতত কাজ একটাই-পুনর্গঠন। পথ-ঘাট মেরামত করিতে হইবে, রেল স্টীমার চালু, করিতে হইবে, অফিস আদালত স্কুল কলেজের বন্ধ দুয়ার খুলিতে হইবে, কলকারখানায় মাঠে ঘাটে আবার জীবনছন্দ ফিরাইয়া আনিতে হইবে। ভারত সেজন্য উদ্যোগী হইয়াছে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে পঞ্চান্ন কোটি মানুষ যােগ দিলে হয়তাে অসাধ্য সাধিত হইবে। কিন্তু তাহার জন্য চাই উপযুক্ত পটভূমি। নানা রাজনৈতিক দল মুক্তি-সংগ্রামে যেভাবে এক পতাকার নীচে সমবেত হইয়াছিলেন—আজও ঠিক তেমনই একসঙ্গে পা ফেলিয়া না-আগাইলে শক্তির অহেতুক অপচয় হইবে মাত্র। বাংলাদেশের পক্ষে আজ সেটা বিলাসিতার সামিল। শাসনতন্ত্র লইয়া এত ভাবনার কী আছে? জনমত যাহাদের ম্যানডেট দিয়াছে, তাহাদের অধিকার অনস্বীকার্য। ভারতের শাসনতন্ত্র যে গণপরিষদ রচনা করিয়াছিল তাহারা কিন্তু ছিলেন পূর্ব-নির্বাচিত। সত্য, মুক্তিযুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক চরিত্রে গুণগত পরিবর্তন ঘটিয়াছে। সে পরিবর্তনের সার কথা এটাই ; আর স্বায়ত্তশাসন নয়, এবার প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
২৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা