তাহার সূচনা
এই সূচনা ঘটাইয়াছেন যিনি তাহার নাম প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। এদেশে হয়তাে ইহার চেয়ে বড় মানবিক, বৈরাগী অথবা অলৌকিক নেতৃত্ব পাইয়াছে, কিন্তু এমন সফল, সার্থক, বাস্তব, পরিচালনা আর কখনও না। ধীরে ধীরে তিনি জাতিকে এই উজ্জ্বলন্ত জয়ের দিনে পৌছাইয়া দিয়াছেন । ইহার মধ্যে সতর্কতা হিসাব সবই হয়তাে ছিল, কিন্তু আজ সব ছাপাইয়া উঠিয়াছে একটি স্থির হাতের কাণ্ডারিপনা, একটি বাস্তবতা। এই বাস্তবতাই আজ বাংলাদেশকে বাস্তব করিয়াছে। সেদিনের ক্লান্ত কংগ্রেস নেতৃত্বের একটি পাপ। পঁচিশ বছর পরে আর একটি কংগ্রেস গভর্নমেন্ট, রক্তের মূল্যে মুছিয়া দিয়াছে । মিথ্যা তত্ত্বের ভিত্তিতে রচিত একটি রাষ্ট্রের একটা অংশ ধসিয়া গিয়াছে। বাকিটাও অটুট থাকিবে কিনা, থাকিলেও কতদিন সেসব কথা। আগামী ইতিহাস খুলিয়া মেলিবে, ধীরে ধীরে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার জন্য করুণা বােধ করি। চীনের চেয়ারম্যানকে তিনিও একরকম “আমাদের চেয়ারম্যান” ঠাওরাইয়াছিলেন তিনি আর ভুট্টো মিলিয়া- কিন্তু পাগলের ঠিক ঠিক মহৌষধই মিলিয়াছে। জিন্না হইতে লিয়াক, লিয়াকৎ হতে আয়ুব, সকলে মিলিয়া যাহা পারেন নাই, তিনি একাই তাহা সম্ভব করিয়াছেন। পাকিস্তান নামে একটা শুধু জোর করিয়া আর জুলুম করিয়া বজায় রাষ্ট্রটিকে ভিত শুদ্ধ টলাইয়া দিয়াছেন। নিছক জেদের বশে। নিছক ভ্রঙ্গীনায়কদের তর্জনীর নির্দেশে। ইহার পর তিনি নিজে কতদিন মেজাজে খােশ এবং তবিয়তে বহাল থাকেন সেটা অপেক্ষার বিষয়। চূড়ান্তভাবে জব্দ একটি সেনাবাহিনী আর তার নায়ককে কোনও দেশ, কোনও কালে ক্ষমা করে নাই। পাকিস্তান দ্যাট ইজ ওয়েস্ট পাঞ্জাব, ইহার পর খন্ড খন্ড হইয়া ভাঙিয়া পড়িতে পারে, অধিকৃত কাশ্মীর ওই অঞ্চলের বাকি অংশের সঙ্গে পুনর্মিলিত হইতে পারে । | এসবই আপাতত জল্পনা। একটি বৃত্ত এখনও পূর্ণ আবর্তনের পরে পূর্ব বিন্দুতে আসিয়া মেশে নাই, ইহা ঠিক। তবে ইহাও ঠিক যে, পিণ্ডিশাহীর পৃষ্ঠপােষক আমেরিকা আর চীনের সব হিসাব ভণ্ডুল হইয়া গিয়াছে।
এই ভূভাগে তাহারা অত্যাচারী আর হত্যাচারী একটা মুলুককে মদত আর দাদন দিয়া চলিয়াছিল এই আশায় যে, ইণ্ডিয়াকে জব্দ আর ঠাণ্ডা রাখা যাইবে। আজ পাক সমরযন্ত্র ভগ্নজানু, হতরথ, তাহাদের বড় আশায় ছাই। পড়িয়াছে। খানসেনার পরাজয় যতটা না পিণ্ডিশাহীর পরাজয়, তার চেয়েও বড় পরাজয় আমেরিকার আর চীনের। এই উভয়েই যাচিয়া এই অপমান মাথায় তুলিয়া লইয়াছে। এই পরাজয় আন্তর্জাতিক চক্রান্তেরও, তাহারা ভারতকে, তাহার শক্তিতে চেনে নাই । গানবােট ডিপ্লোম্যাসি নিজের শঠতায় না যৌ হইয়া দাঁড়াইয়া। আছে। আজ আমাদের সুখের দিন, আজ আমাদের বিজয়ের দিন, আমাদের “ফাইনেন্ট আওয়ার” । এক হিসাবে। বিষাদের দিনও বটে। বঙ্গবন্ধু, যিনি ভারতবন্ধু ও, তিনি কোথায়, জানা নাই। আমাদের প্রতিবেশী দেশে একটি জাতি জন্ম লইয়াছে, জন্মের প্রথম শুভক্ষণে জন্মদাতা নয়ন সম্মুখে নাই। তিন কি জীবিত? তাহার মহাজীবনের প্রার্থনা করি, তবু এই শুভ মুহূর্তে বিষাদ আসিয়া যেন গ্রাস না করে। জীবিত থাকিলে মুজিব মহা মৃতুঞ্জয়, আর নহিলেও একটি জীবনে লভিয়া জীবন অনেক দেশ জাগিয়াছে, ইতিহাসে এমন সান্ত্বনার দৃষ্টান্ত বিস্তর। আজ অক্ষরে অক্ষরে সে সত্য লেখা হইয়া গেল, আগামী কাল তাহা সবুজে আর স্বর্ণবর্ণে ফুটিয়া উঠুক। | পরীক্ষার দিন এখনও সামনে পড়িয়া আছে। জঙ্গীশাহী আত্মসমর্পণ করিয়াছে পূর্বভাগে, এখনও পশ্চিমে তাহার বিষদাত ভাঙে নাই। বাকি আছে একটি নব জাতকের অর্থনৈতিক উজ্জীবন, উনূল শরণাগতদের মানসিক ও সার্বিক পূণর্বাসন। আজ যাহা মিত্র বাহিনী আর মুক্তি বাহিনী কাল তাহা যেন দখলদার ফৌজের অপযশ না পায় তাহাও দেখিতে হইবে। বাকি আছে সাংস্কৃতিক সেতু নূতন করিয়া রচনা । কিন্তু এই মুহুর্তে এসব প্রশ্ন তােলা থাক। যে ভূখণ্ডে দুইটি দেশ আজ হাত মিলাইতেছে সেখানে বহিতেছে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা; বহে চলে ধলেশ্বরী । আর, তাহার পরে, “যে আছে অপেক্ষা করে তার পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।” এই সিন্দুরাভ ভােরে তাহাকে অভিনন্দন। জয় বাংলা, জয় হিন্দু।
১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা