You dont have javascript enabled! Please enable it!

চতুরতার প্রাচীর

ঐতিহাসিক সুরেন্দ্রনাথ সেন তাঁহার ‘মারাঠার সামরিক ইতিহাস গ্রন্থে একটি যুদ্ধের তথ্য বিবৃতি করিতে গিয়া লিখিয়াছিলেন যে, হায়দার আলির সৈন্য শ্রী রঙ্গপত্তনের অদূরে বিখ্যাত সারদা মন্দিরের প্রাচীরের আড়ালে থাকিয়াও কামান বিন্যাস করিয়া বিপক্ষ মারাঠা বাহিনীর উপর গােলাবর্ষণ করিতেছিল; কিন্তু মারাঠার আক্রমণের আবেগ তাহাতে কুণ্ঠিত হয় নাই । মন্দিরের প্রতি মারাটা সৈন্যের স্বাভাবিক শ্রদ্ধার সংস্কার একটা বাধা হইয়া মারাঠাবাহিনীর আক্রমণের প্রবলতা মন্দীভূত করিতে পারে নাই। মারাঠা বাহিনী তােপ দাগিয়া সারদা মন্দিরকে বিধ্বস্ত করিয়াছিল ও হায়দার আলির সৈন্যের উচ্ছেদ উদ্ধোধন করিয়াছিল। ঘটনাটি তর্কের বিষয়বস্তু হইতে পারে। কেহ বলিবেন, মারাঠাবাহিনী মন্দির ধূলিসাৎ করিয়া ভাল কাজ করে নাই। যুদ্ধের সুবিধার জন্য অথবা যুদ্ধে চূড়ান্ত জয়লাভ করিবার জন্য কি অভ্যস্ত ধার্মিক সংস্কারকে একেবারে তুচ্ছ করিতে হইবে? কেহ বলিবেন, মারাঠাবাহিনী বাস্তবসম্মত কাজ করিয়াছিলেন। বিপক্ষ হায়দার আলির বাহিনী মারাঠাদের ধার্মিক সংস্কারকে বস্তুত দুর্গপ্রাচীর হিসাবে কাজে লাগাইবার কৌশল গ্রহণ করিয়াছিল। কৌশলের যুক্তিটা এই যে, মারাঠারা ধর্মসংস্কারবশত মন্দিরের উপর তােপ দাগিবে না। সুতরাং মন্দিরের প্রাচীরকে দূর্গপ্রাচীর হিসাবে ব্যবহার করিয়া, বিপক্ষের উপরে কামান দাগিবার সহজ সুবিধা গ্রহণ করা হােক। ক্ষত্রিয়ের যুদ্ধনীতিতে নির্দেশ ছিল, শত্রুর হাতের তরবারি পড়িয়া গেলে তাহাকে আর আক্রমণ করিও না। শত্রুর হস্তস্থালিত তরবারিকে তাহার হাতে আবার তুলিয়া দাও, তাহার পর আবার দুইজনে পরস্পরের বিরুদ্ধে আঘাত হানিয়া লড়িতে থাক। রাত্রিকালে শত্রু যখন তাহার শিবিরে নিদ্রিত অবস্থায় রহিয়াছে, তখন তাহাকে আক্রমণ করিও না। ইত্যাকার ক্ষমাপ্রবণ ও দয়ামায়া সম্বলিত মানবতার নানা নীতি ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য নিয়ন্ত্রিত করিত বলিয়া শােনা যায় ।  

আধুনিক কালের যুদ্ধেও মানবতার কিছু কিছু নীতি অবশ্য পালনীয় বলিয়া বিহিত হইয়াছে। অসামরিক জনসাধারণের উপর আক্রমণ আধুনিক কালের যুদ্ধেও নীতি-বিরুদ্ধ বলিয়া বিবেচিত। জেনিভা কনভেনশন আহত শত্রুর ও বন্দী শত্রুর সম্পর্কে সদয় ব্যবহারের বিবিধ বিধি নির্দিষ্ট করিয়াছে। সভ্য জাতির সৈনিক হইলে তাহার পক্ষে এইসব বিধি পালন করিতে মনের দিক হইতে কোন বাধা বা আপত্তি থাকে না। কিন্তু সারদা মন্দিরের প্রাচীরের আড়ালে সৈন্য সমাবেশ করিয়া যুদ্ধ করিবার ঘটনাটি একটি বিশেষ সমস্যার দৃষ্টান্ত। এ ক্ষেত্রে বুঝিতে অসুবিধা নাই যে, মানবতার নীতি ও ধর্মসংস্কারকে বিপক্ষ বাহিনীর সামরিক উদ্দেশ্যকে বিড়ম্বিত ও বিব্রত করিবার কাজে লাগানাে হইয়াছে। সুতরাং বিপক্ষ বাহিনীর পক্ষে উহাকে মান্য করিবার কি কোন নৈতিক দায়িত্ব আছে? ঢাকার পাকিস্তানী সামরিকেরা বিদেশিকে অপসারণ করিবার, সাধারণ, অসামরিক হাজার হাজার নরনারী। ও শিশুকে সম্ভাব্য যুদ্ধ-এলাকা হইতে নিরাপদ দূরত্বে অপসারিত করিবার কোন চেষ্টা করিতেছে না। তাহারা নিরীহ অসামরিক জনসাধারণকে যুদ্ধ এলাকার মধ্যে সামরিক বাহিনীর অবস্থানের সহিত মিশাইয়া রাখিবার কৌশল গ্রহণ করিয়াছে। ভারতীয় সৈন্যাধ্যক্ষ শ্ৰীমানেকশ বারংবার অনুরােধ সতর্কবাণীর দ্বারা ঢাকার পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করিতে বলিয়াছেন। শেষ অনুরােধঃ আত্মসমর্পণ যদি না কর তবে অন্তত বিদেশি ও অন্যান্য অসামরিক জনসাধারণকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানে অপসারিত কর । কিন্তু এই অনুরােধও উপেক্ষিত হইতেছে। প্রশ্ন করা চলে, এভাবে আর কতদিন? আর কতক্ষণ ঢাকার পাক সামরিক শিবিরের এই কৌশলকে ভারতীয় বাহিনীর ঢাকা অধিকারের প্রধান অভিযান এবং চূড়ান্ত আক্রমণের মুহূর্তটিকে বিলম্বিত করিবার সুযােগ দেওয়া চলিতে পারে?

১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!