ময়না কোথায়
বাংলাদেশের হরেক রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী এখন জোরকদমে আগুয়ান; এবং সেই দুর্বার অগ্রগতির সম্মুখে পাক-বাহিনীর ঘাঁটিগুলি কেন তাসের বাড়ির মতাে ধসিয়া পড়িতেছে। বসিয়া পড়িতেছে’ বলা যায়, উড়িয়া যাইতেছে’ বলিলেও অত্যুক্তি করা হয় না; আবার চিত্রকল্পটাকে পালটাইয়া লইয়া এমনও বলা চলে যে, আগুনে তাতানাে একখানি ছুরিকা এখন জমানাে একতাল মাখনের মধ্যে দিয়া ছুটিতেছে। সর্ব রণাঙ্গনেই এক অবস্থা, এবং সবদিক হইতেই ছুরিকা এখন ঢাকার দিকে উদ্যত। কিন্তু, ঢাকার বেতারে গােটাকয় তােতাপাখি এখনও তারস্বরে চেঁচাইলে কী হয়, আসল দুই চিড়িয়া নাকি ইতিমধ্যেই বেপাত্তা সংবাদে প্রকাশ, গতায়ু পূর্ব পাকিস্তানের মালিকানা ছাড়িয়া মালিক সাহেব ইতিমধ্যেই পিণ্ডির পথে সরিয়া পড়িয়াছেন। তাহার সঙ্গে গিয়াছেন নিয়াজি। গভর্ণর নাই, চীফ মিলিটারি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর নাই, নিতান্ত ইহাদের চিড়িয়া বলিয়া। ফেলিয়াছি, নহিলে নিশ্চয় চিত্রকল্পটাকে পুনশ্চ পালটাইয়া লইয়া বলা যাইত যে, ডুবন্ত জাহাজ হইতে দুইদুইটা ধাড়ী ইদুর সরিয়া পড়িল।
কিন্তু সরিয়াই বা যাইবে কোথায়? বঙ্গোপসাগরে ঝড় উঠিয়াছে ঠিকই কিন্তু পাকিস্তানের উপকূল বরাবর। আরব সাগরের হাওয়াও তাে ঠিক এই মুহূর্তে বিশেষ স্বাস্থ্যকর নয়। সেখানেও হরেক খণ্ডে পাক-বাহিনীর। এখন হাঁটুভাঙ্গা ‘দয়ের দশা। মাটির উপরে ভাঙা পাটাতনের পাহাড়, মাথার উপরে’? ভারতীয় ‘ন্যাট’ আসিয়া মুহুর্মুহু চক্কর মারিয়া যায়, ওদিকে ভারতীয় নৌ বাহিনীর গােলার ঘায়ে করাচী বন্দর কুপােকাত। কয়েকটা দিন আগের খবর, গােটা বন্দর দাউদাউ করিয়া জ্বলিতেছে। সময় বুঝিয়া আফগানিস্তান হাঁক ছাড়িয়াছে ? পাখতুনিস্তানের কী হইল? অর্থাৎ কিনা, ফাকিস্তানের এখন সর্বদিকেই বেসামাল অবস্থা। অপিচ লক্ষণীয়, সেই নাভিশ্বাসের লগ্নেই ঠিক হইয়া গেল, জঙ্গীশাহী অতঃপর কাহাকে উজিরে আজম সাজাইবে, আর কাহাকে তাহার সাকরেদ। চমক্কার গাঁটছাড়া। নবীন কচি ভুট্টোর দিকে অপাঙ্গে তাকাইয়া বৃদ্ধ নুরুল হয়ত এখন গোঁফে আতর মাখিতেছেন । মাখুন, তাহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই। মৃত্যুর আগে হিটলার নাকি বিবাহের শখ মিটাইয়া লইয়াছিলেন; ইহারা সে ক্ষেত্রে গদিয়ান হওয়ার শখ মিটাইয়া লইবেন না? | কিন্তু আবর্জনার স্তুপ হইতে নুরুল আমিনকে কুড়াইয়া লইয়া, এবং কিঞ্চিৎ সাফসুতরাে করিয়া, তাহাকে যিনি ভাঙা ফাকিস্তানের উজিরে আজমের তক্তে বসাইতে চলিয়াছেন, সেই জবরজঙ্গী ইয়াহিয়া এখন কোথায়? নভেম্বরের পঁচিশ তারিখেই তিনি তাল ঠুকিয়া বলিতেছিলেন যে, দিন দশেক বাদে আর তাঁহার দেখা মিলিবে না, তখন তিনি যুদ্ধে। | খাঁ সাহেব নিশ্চয় কথার খেলাপ করেন নাই। ধরিয়া লওয়া যায় যে, এখন তিনি যুদ্ধ করিতেছেন। কিন্তু। প্রশ্ন, কোন্ রণাঙ্গনে? তিনি কি প্যাটসে চড়িয়া বারমার খণ্ড লড়াই দিতে গিয়েছিলেন? নাকি করাচীতে গিয়া ভারতীয়-যুদ্ধ জাহাজে তাক করিয়া বন্দুক চালাইয়াছিলেন? নাকি স্যার জেটে উঠিয়া তিনি দিল্লির আকাশে চক্র মারিবার তালে আছেন? ময়না কোথায়? যেখানেই থাকুন, হঠাৎ এমন চুপ মারিয়া গেলেন কেন? কিংবা ভুট্টোর সঙ্গে তিনিও ইতিমধ্যে নিউইয়র্কে সরিয়া পড়েন নাই তাে?
১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা