জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে
সীমান্তের ওপারে লড়াই সমানে চলিতেছে। এক দিকে হিংস্র জঙ্গীশাহী অত্যাচারী সরকারের রক্তলােলুপ ফেীজ-অতি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে তাহারা সুসজ্জিত; অপর দিকে নিপীড়িত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী নাগরিকদের নির্ভীক মুক্তিসেনানী-তাহাদের সম্বল অমিত সাহস, অটুট মনােবল। পশ্চিম পাকিস্তানের দুর্ধর্ষ বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাহাদের একদিন কেন, একদণ্ডও টিকিবার কথা নয়। কিন্তু সমগ্র বিশ্বকে বিস্মিত ও চমকিত করিয়া ইসলামাবাদের নৃশংস সেনাদের সহিত তাহারা সমানে লড়িয়া যাইতেছে। জঙ্গীশাহী এতই বিচলিত ও উদ্ৰান্ত যে, তাহারা কী করিবে ভাবিয়া পাইতেছে না। নিরস্ত্র নাগরিকদের প্রতিরােধ যে এমন দুর্বার হইতে পারে সে কথা তাহাদের কল্পনাতেও আসে নাই। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকিবার জন্য তাহারা তাই প্রাণপণ মিথ্যা রটাইতেছে। কখনও বলিতেছে খুলনা শান্ত, আবার পর মুহূর্তে বলিতেছে সেখানে আরও সৈন্য নামানাে হইয়াছে। কখনও বলিতেছে বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া আসিয়াছে, আবার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুবর্গের কাছে সনির্বন্ধ অনুরােধ জানাইতেছে—আরও অস্ত্র দাও দাও আরও সামরিক সরঞ্জাম। ইসলামাবাদের দোস্ত বিস্তর, মুরুব্বীও অনেক। যদিও ইদানীং ‘তাহার পক্ষ হইতে বলা হইয়াছে সেন্টার। সঙ্গে তাহার কোনও সম্পর্ক নাই, বিপদে পড়িয়া সেই সেন্টারই সে দ্বারস্থ হইয়াছে। বাংলাদেশের অবস্থা যদি আয়ত্তের মধ্যে আসিয়া গিয়ই থাকে তাহা হইলে অস্ত্রশস্ত্রের জন্য এমন কাকুতি-মিনতি কেন? সারা দুনিয়া চষিয়া ফেলিবারই বা কী দরকার? এক মিথ্যা ঢাকিতে গিয়া পশ্চিম-পাকিস্তানী ধুরন্ধরেরা আরও সাতটা মিথ্যা বলিতেছেন। তবুও কিন্তু সত্যটা ঢাকিয়া রাখা যাইতেছে না। দুনিয়া-সুদ্ধ লােক টের পাইয়া গিয়াছে নিজেদের জমিদারি বজায় রাখিবার জন্য কী নির্মম অত্যাচারই না জঙ্গীশাহী বাংলাদেশের অস্ত্রহীন জনতার উপর করিতেছে। বাড়ি ঘর জ্বালাইয়া দিতেছে, কারখানা পুড়াইয়া ছাই করিয়া ফেলিতেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ও তাহাদের বর্বর আক্রমণ হইতে রক্ষা পায় নাই। স্কুল-কলেজের কথা না হয় ছাড়িয়া দিলাম।
এত করিয়াও কিন্তু বাংলাদেশের অধিবাসীদের স্বাতন্ত্র্যস্পৃহাকে দাবাইয়া রাখিতে পারে নাই জঙ্গীশাহী, তাহাদের নতিস্বীকার করানাে তাে দূরের কথা। তবুও ভুলিতে পারা যায় না, যে লড়াই আজ বাংলাদেশের শহরে শহরে চলিতেছে, যে সংগ্রামে ঝাপাইয়া পড়িতে সীমান্তের ওপারের প্রতিটি গ্রাম উগ্ৰীৰ সে লড়াই, সে সগ্রাম অসম। তাহার এক পক্ষ প্রবল—তাহার সৈন্যসামন্ত আছে, হাতিয়ার আছে, প্রচুর অর্থ আছে, আর আছে দুনিয়ার দরবারে কূটনৈতিক স্বীকৃতি। অতএব আন্তর্জাতিক আইনের দোহাই পাড়িবার অধিকার তাহার আছে। সেই সুবাদেই সে বাংলাদেশের শ্যামল বুকে রক্তের স্রোত বহাইয়া দিতেছে। অপর পক্ষ দুর্বল অত্যাচারিত, নিপীড়িত, নিষ্পেষিত । তাহার না আছে সুশিক্ষিত সেনা, না সুসজ্জিত বাহিনী, ট্যাঙ্ক, বিমান, রণতরী কিছুই নাই। এমন কী আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রেরও অভাব। অর্থও তাহার নাই। বিশ্বের দরবারে তাহার দাবি এখনও অস্বীকৃত। অতএব সে বিদ্রোহী আন্তর্জাতিক আইনের ছত্রছায়া হইতে সে বঞ্চিত তাহার কান্না শুনিয়া ইরান, তুরস্ক হইতে কেহ ছুটিয়া আসে নাই। তাহার সম্বল বুকের পাটা মনের বল, দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। প্রবল প্রতিপক্ষের নিষ্ঠুর আঘাতে তাই বাংলাদেশের মুক্তি-পুজারীর দল ভাঙিয়া পড়ে নাই। অত্যাচারীকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে তাহারা কৃতসংকল্প। তাহার জন্য আত্মাহুতি দিতে লক্ষ লক্ষ বীর প্রস্তুত। তবুও শুধু হাতে তাে আর বােঝা যায় না, শূন্য উদরেও নয়। পশ্চিম বঙ্গের নাগরিকেরা বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণকে এ আশ্বাস দিয়াছে সীমান্তের এপারের সাড়ে চার কোটি অধিবাসী ওপারের সাড়ে সাত কোটির সঙ্গে একাত্ম। সে আশ্বাস ওপারের বীরদের উৎসাহিত ও উজ্জীবিত করিবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে রসদও। যদি এপার হইতে যােগান দেওয়া যায় তাহা হইলে তাহাদের বাহুতে নতুন করিয়া বল আসিবে, বক্ষে নতুন ভরসা। সমগ্র জাতির পক্ষ হইতে বাংলাদেশে উপঢৌকন পাঠাইবার আয়ােজন করিতে হইবে অবিলম্বে । খাদ্য, বস্ত্র, ঔষধ, আহতদের রক্তদান করিবার ব্যবস্থা সবই যত শীঘ্র সম্ভব করিতে হইবে। আন্তর্জাতিক রেডক্রস যদি সুদূর ইউরােপ হইতে ঢাকায় সাহায্য পাঠাইতে আগ্রহী হয়, এত কাছের মানুষ আমরা-আমরা কী হাত গুটাইয়া বসিয়া থাকিব? পদ্মা-মেঘনা-কর্ণফুলির তীর হইতে অস্ত্র-সাহায্যের যে আকুল আবেদন আসিয়াছে সে কী বৃথায় যাইবে? মুজিবর রহমানের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দিবার যে দাবি উঠিয়াছে। তাহাও কী উপেক্ষিত হইবে? বাংলাদেশের ওই যুগসন্ধিক্ষণে তাহার পাশে যদি আমরা দাঁড়াইতে না পারি তাহা হইলে কিসের আমাদের গণতন্ত্রের অহঙ্কার, স্বাধিকারের গর্ব।
৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা