You dont have javascript enabled! Please enable it!

একমাত্র সন্তানের বিনিময়ে

আপন হাতে এক জননী তাহার একমাত্র সন্তানের প্রাণবিনাশ করিয়াছেন। নাহলে নিশ্চয় পঞ্চাশ জন শরণার্থীর প্রাণ বাঁচিত না। বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের সূত্র প্রাপ্ত এই সংবাদ প্রকাশ, শরণার্থীর দলটি ফরিদপুর হইতে ভারতবর্যের দিকে আসিতেছিলেন। পথিমধ্যে একদল পাক-সেনাকে দেখিয়া তাহারা আত্মগােপন করেন এবং এক শরণার্থী নারীর ছয় মাসের শিশু তখন কাঁদিয়া ওঠে। মা তাহার কান্না থামাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু পারেন নাই। সবলে তিনি তখন শিশুর কণ্ঠ চাপিয়া ধরেন। শিশুটি মারা গিয়াছে। কিন্তু বাঁচিয়া গিয়াছেন পঞ্চাশ জন শরণার্থী। শিশুর কান্না যদি না থামিত তবে পাক সেনারা যে ওই  শরণার্থীদের সন্ধান পাইয়া যাইত, তাহাতে সন্দেহ নাই এবং পাক জঙ্গীশাহীর পৈশাচিক নিষ্ঠুরতার যে অজস্র নজির ইতিমধ্যে মিলিয়াছে তাহাতে অনায়াসেই বলিয়া দেওয়া যায় যে, পঞ্চাশ জন শরণার্থীর মধ্যে একজনও সে-ক্ষেত্রে রক্ষা পাইতেন না। তাহারা রক্ষা পাইয়াছেন। কিন্তু তাহাদের রক্ষা করিবার জন্য অজ্ঞাত অখ্যতি এক জননীকে সেদিন যে মূল্য দিতে হইয়াছে তাহার বিবরণ শুনিয়া সমগ্র জননী-সমাজই আতঙ্কে শিহরিয়া উঠিবেন। যে-কোনও জননীর জীবনে সেই মূল্য বস্তুত চরম মূল্য। এমন কী মানবেতর প্রাণী-সমাজের দিকে তাকাইলেও তিলমাত্র সন্দেহ থাকে না সে জননীর জীবন সেখানেও সন্তানের জীবনকে কেন্দ্র করিয়া আবর্তিত কীভাবে নিজের জীবন বিপন্ন করিয়া সন্তানকে রক্ষা করিবার প্রয়াস পায় কে তাহা দেখেন নাই? মার্জার কিংবা সারমেয়-জননী যে তাহাদের সন্তানদের রক্ষা করিবার জন্য কীভাবে শত্রুর বিরুদ্ধে রুখিয়া পাড়ায়, কাহার তাহা চোখে পড়ে নাই? সন্তান যেখানে বিপন্ন সেখানে নিজের জীবন কিংবা নিরাপত্তার ব্যাপারে সব জননীই সম্পূর্ণ ভ্রুক্ষেপহীন। তাহাদের সমস্ত চিন্তা আর সমস্ত উদ্যমের লক্ষ্য তখন সন্তানের প্রাণরক্ষা।

স্নেহবিহবল করুণাছলছল শিয়রে জাগে’ যার আঁখি সেই জননীকে সকল জননীর মধ্যেই খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে। তবু মানব-জননীর বাসল্যের যে একটা স্বতন্ত্র মহিমা আছে তাহাও স্বীকার্য। মহিমা এইখানে যে সন্তান বয়প্রাপ্ত হইবার পরেও তাহার সম্পর্কে মানব-জননীর উদ্বেগের অবসান হয় না। সে-দিক হইতে সমস্ত জননীর সমস্ত সন্তানই আসলে শিশুসন্তান। বয়স যাহাই হউক, মায়ের চোখে তাহারা সকলেই নিতান্ত শিশু। মানবজননীর বাৎসল্য, সে-দিক হইতে, সমগ্র জীবনব্যাপী একটি ঘটনা। বলা বাহুল্য, পঞ্চাশ জন শরণার্থীর প্রাণরক্ষার জন্য বাংলাদেশের যে জননী আপন হাতে আপন সন্তানের প্রাণ-বিনাশ করিয়াছেন, বাৎসল্য। তাঁহারও কিছু কম ছিল না। বলা বাহুল্য, তাহারও অস্তিত্ব ওই একমাত্র সন্তানের জীবনকে কেন্দ্র করিয়াই আবর্তিত হইত। সন্তানের জীবন এ ক্ষেত্রেও ছিল জননীর আপন জীবনেই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেই সন্তানকে হারাইয়া তাহার নিজের জীবনই একেবারে রিক্ত হইয়া গিয়াছে। সেই বিচারে এই জননী বস্তুত সন্তানের প্রাণনাশ করেন নাই; নিজের জীবনকেই তিনি নিজের হাতে বিনষ্ট করিয়াছেন। আপাত-বিচারে যাহা সন্তানের প্রাণবিনাশ বস্তুত তাহা যে এক জননীর আত্মােৎসর্গেরই ঘটনা, তাহাতে তিলমাত্র সংশয়ের অবকাশ এ ক্ষেত্রে কোথায়?

৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!