প্রথম পর্ব আমাদের
প্রথম পর্ব আমাদের। এই যুদ্ধের দুই দিনের হিসাব-নিকাশ আর যােগ-বিয়ােগের ফল এই আশ্বাসটুকু বহন করিয়া আনিয়াছে । প্রকাণ্ড কোনও আনন্দ সংবাদ যদি নাও থাকে, নানা ফ্রন্ট আমাদের সাফল্যের একটার পর একটা চিত্র উঘাটিত করিয়া দিতেছে। তাহাই যথেষ্ট; মাত্রাধিক প্রত্যাশা যাহাদের তাঁহারা জাতির সংকটে জাতির শরিক নহেন, অথবা তাহারা নিতান্তই স্বপ্নবিলাসী। দুর্নিবার এক সর্বঘ্ন ঘাতক আর বিশ্বাসঘাতকের দলকে চ্যালেঞ্জ করিয়াছে ভারত-কিন্তু মনে রাখিতে হইবে ওসব দৈত্য নহে তেমন’। বাস্তব বিশ্লেষণের প্রয়ােজনে প্রথমেই আমরা ফ্রন্টগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করিয়া লইতে পারি। এক. রণাঙ্গন; দুই. গৃহাঙ্গন; তিন, আন্তর্জাতিক অঙ্গন। তিনটি মিলিয়া নিঃসংশয় স্বরে বলিয়া দিতেছে—প্রথম পর্ব আমাদের। | প্রথম পর্ব আমাদেরকেননা আমাদের জওয়ানেরা ইতিমধ্যেই স্থলপথে শুধু প্রতিপক্ষের আঘাত সামলান নাই, হামলার বদলাও লইয়াছেন। ছিনাইয়া আনিয়াছেন একটার পর একটা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, সরবরাহের ঘাঁটি। মানচিত্রে নতুন নতুন চিহ্ন পড়িতেছে। পাক হাওয়াই শক্তি অন্তত পূর্বখণ্ডে হাওয়ায় মিলাইয়া যাওয়ার উপক্রম, কঙ্কালসার হ্যাঙারের পর হ্যাঙার আর বিধ্বস্ত বিমানগুলি তাহার প্রমাণ। আমাদের সামরিক বাহিনীর তিন সঙ্গীর মধ্যে তরুণতম সঙ্গী নৌবহর এবার এবং এই প্রথম আগাইয়া আসিয়াছে পুরােভাগে। তাহার অনলবর্ষী নলে তাহার অধিকার আর আধিপত্যের ইতিহাস ঘােষিত হইয়া চলিয়াছে।। | গৃহাঙ্গনে রাষ্ট্রের সঙ্গে একাত্ম হইয়া দাঁড়াইয়াছে জাতি, দলগত বিদ্বেষ-বিভেদ এই মুহূর্তে সমাহিত। আরও কিছু চাই । শুধু কুবরণ, শুধু সাহস আর একতাই নয়, সব দিয়া তবে প্রতিষ্ঠা অর্জন, অসাধ্য সাধনের এই একমাত্র পণ। এ যুদ্ধ একা সরকার চালাইতেছেন না, সমগ্র জাতিকে এই উপলব্ধিতে উদ্বুদ্ধ হইতে হইবে, যুদ্ধে লিপ্ত একটা গােটা জাতি । এই চেতনা একসূত্রে সকলকে বাঁধিয়া নিবে কেননা পরাভব মানে কেবল জওয়ানদের পরাভব নয়, ঘটিলে তাহা হইবে আসমুদ্র হিমাচল প্রত্যেকটি দেশবাসীর।
প্রথম পর্ব আমাদের-রাষ্ট্রপুঞ্জে আপাতত চুপসানাে মার্কিন চক্রান্ত সেই স্বস্তির বাণীটি লইয়া আসিয়াছে। জরুরী বৈঠক ডাকা হইয়াছিল নিরাপত্তা পরিষদের। কেননা আট মাস নিশ্চিন্তে সুখসুপ্ত মার্কিন নায়কদের তন্দ্রা সহসা টুটিয়া গিয়াছে। তাহারা ভাবিয়াছিল সােভিয়েতের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ভারতের উপর এইভাবেই শােধ তােলা যাইবে। বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত? তােমাদের খল রসনা খসিয়া পড়ুক মিথ্যাবাদীর দল। সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর বর্বরতম বিক্রম প্রদর্শনে বুঝি বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হয় নাই? লক্ষ লক্ষ মানুষ ছিন্নশির, এক কোটি নরনারী আজ ছিন্নমূল, আর সেই পটভূমিতে গণতান্ত্রিক আদর্শ ধর্ষিত হইয়া পড়িয়া আছে। “বিশ্বশান্তি’ তবুও কী আশ্চর্য, অটুট রহিয়াছে। বাংলাদেশের উপর অবাধ হত্যালীলা চালাইয়া উৎকট উৎসাহী খুনীরা কামানের নিশানা করিয়াছে ভারতের বুক । আমেরিকা আর পাকিস্তানের পাপের অন্যান্য স্বেচ্ছভাগীরা তাহাতে কিছুমাত্র বিচলিত হয় নাই। | বিচলিত তাহারা এখন, যখন প্রত্যাঘাতের পালা; মুক্তিবাহিনী আর ভারতীয় সেনা যখন পাশাপাশি, আদরের ইয়াহিয়ার, সােহাগের স্বৈরতন্ত্রের শেষ সমাসন্ন দেখিয়া আমেরিকা আসরে নামিয়াছে এবার, যত ফেউ আর শৃগালেরা তাহার সুরে সুর মিলাইয়াছে । কিন্তু টেবিলে প্রচণ্ড একটি মুষ্টাঘাত করিয়া শিক্ষক যেন বিশাল একটা ক্লাসের সব হট্টগােল থামাইয়া দিলেন-রুশ ভিটোর ইহাই তাৎপর্য ও তুলনা। মার্কিন প্রস্তাব অপঘাতে মৃত, ভিটোর আঘাতে ধরাশায়ী। সেই প্রস্তাবে ভারত আর পাকিস্তান ছিল একই বন্ধনীভূক্ত, আততায়ী আর, আহতকে একই কাঠগড়ায় পুরিবার সে এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। আমেরিকা অস্ত্রসংবরণের কথায় মুখর, কিন্তু রাজনৈতিক মীমাংসার বিষয়ে একেবারে মৌনীববাবা মুক।
রাশিয়া অন্ধ নহে, ওই বােবাকে তাই ভালমতই জব্দ করিয়াছে। ১৯৬৫ আর ১৯৭১ এক নহে। সেবার যুদ্ধবিরতি সম্ভব হয় কারণ রাশিয়া আর আমেরিকা দুইয়ে মিলিয়া এক দ্বৈতসঙ্গীত রচনা করে। আমাদের দফা রফা করার জন্য তেমন কোনও রফা প্রস্তাব এবার নাই, তাসখন্দের পুনরাবৃত্তি আর নহে। এবার আমেরিকা যদি ভারতকে দায়ী করিয়া থাকে তবে রাশিয়া দায়ী করিয়াছে পাকিস্তানকে। আর চীন? তাহার ভূমিকা এখনও প্রহেলিকা। পিভির প্রতি তাহার পীরিতি এখনও বিলক্ষণ। নিজস্ব কোনও প্রস্তাবও তাহার ঝুলিতে থাকিতে পারে-সেসব জানা যাইবে পরে। পিকিংয়ের নৈতিক সমর্থনের | কাটাটা যে হেলিয়া আছে পাকিস্তানের দিকে, তাহাতে ভুল নাই কিন্তু নিছক নৈতিক মদতে কাজ হয় না, পিকিংয়ের অমায়িক ভালবাসার নখদন্তও আছে কি না সেটা না-জানা অবধি পাকিস্তানের ভরসাও নাই। | নিরপেক্ষ ছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্স-এই ব্যাপারটারও মূল্য কম নহে (প্রসঙ্গত ব্রিটিশ পত্রপত্রিকার মতামত আবার ভারতের দিকে ঘুরিতেছে)। আন্তর্জাতিক আসরে প্রথম পর্ব এই পর্যন্ত। অর্থ এই নয় যে, বাংলাদেশ এবং ভারতকে লইয়া রাজনৈতিক লীলাখেলার এইখানেই ইতি। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আবার বসিবে, রকমারি প্রস্তাব রচিত হইতে থাকিবে, ব্যাঙের ছাতার মতাে একটির পর একটি এখনই তাে গজাইয়া উঠিতেছে। গায়েনদের মধ্যে আছে বেলজিয়াম, আছে জাপান, ইতালী, সেই প্রস্তাবগুলি আসলে আমেরিকারই বকলম। সােভিয়েত প্রস্তাবটি উঠিলে তাহারও ঠিক একই পরিণতি-ভিটো পড়িবে। আমেরিকা যদি বা ছাড়পত্র দেয়, চীন নাও দিতে পারে।
সম্মুখে অতএব এখনও দীর্ঘ পথ, সসম্মান শাস্তি এখনও ‘দূরে। ভারত শান্তি চাহে, স্বাধীন দেখিতে চাহে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের প্রতিনিধির কণ্ঠস্বর যে-আসরে শােনা যায় না, বিশ্বমতের প্রতিনিধিত্ব করার হক ও সেই আসরের নাই। আমরা এ পর্যন্ত যুদ্ধে হারি নাই, হারিয়াছি শান্তিতেই’-সংসদে বলিয়াছেন একজন। সেই হার আবার যেন ফঁাসের মতাে গলায় না-পড়ে। মনে রাখিতে হইবে নিরাপত্তা পরিষদের নির্দেশ মানার কোনও বাধ্য-বাধকতা নাই, নিরামিষ ভক্ষণ আবশ্যিক নহে। আর আমেরিকা? তাহার আজ যেটুকু প্রতিপত্তি, উন্নয়নশীল দুনিয়ায় যেটুকু খাতির তাহা শুধু বাহুবলের কল্যাণে। পাড়ার মাস্তানেরা যে জোরে খাতির আদায় করিয়া থাকে । আন্তর্জাতিক আসরে আজ সেই ভূমিকা আমেরিকার । পাক গােলন্দাজরা আগরতলা শহরে গােলা ছোঁড়ায় এবং পাক বাহিনী সেখানকার বিমানবন্দরে হানা দেওয়ায় বাংলাদেশে লড়াইয়ে চুপচাপ ভাবটা হঠাৎ কেটে গেল। বয়রা ও হিলির মতই এক্ষেত্রে ভারতীয় বাহিনীকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল। পাকিস্তান কেন যে ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি জটিল করার সিদ্ধান্ত নিল, তা তখন বােঝা মুশকিল ছিল। কেননা, মুক্তিবাহিনীর চেয়ে শক্তিশালী কোন বাহিনীর মুখােমুখি হওয়ার অবস্থা তার নয়। বরং সে কোন রকম প্ররােচনা এড়িয়ে চলাই তার পক্ষে সঙ্গত হত। কিন্তু চব্বিশঘণ্টা যেতে না যেতে সব সন্দেহের অবসান হল। কোন ওয়ারনিং না দিয়ে পাক বিমান বাহিনী আমাদের শ্রীনগর, পাঠানকোট, অমৃতসর, আমবালা, আগরা, যােধপুর, ফরিদকোট, অবন্তীপুর ও উত্তরিয়াল বিমান বন্দরগুলিতে হানা দিল। অর্থাৎ, তারা বাংলাদেশে তাদের বাহিনীর উপর চরম আঘাত আহ্বান করল। সর্বাত্মক যুদ্ধে বাংলাদেশে যে হার হবে, একথা পাকিস্তান আগেই ভেবে রেখেছে। পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে বেরিয়ে আসা কর্তৃপক্ষস্থানীয় একব্যক্তি এই ভেবে রাখার বিষয়টা প্রকাশ করে দিয়েছেন।
৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা