সামনে মিলন-স্বর্গ
হাতে হাত ধরিয়া এবং সাথী হইয়া একপথে চলিবার যে আহব্বান অদ্ভুত ইতিহাসেরই একটি অমােঘ ইচ্ছার। দাৰী হইয়া দেখা দিয়াছিল, তাহা আজ পরিপূর্ণ ঘটনায় রূপায়িত হইবার সুযােগ পাইয়াছে। পূর্ব সীমান্তের ভারতীয় বাহিনীর কাছে নির্দেশ আসিয়া গিয়াছে, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সহিত সংযােগ স্থাপন করুন। সুতরাং এখন আর কল্পনা করিয়া দেখিতে হইবে না, চোখ মেলিয়া দেখিতে পাওয়া যাইবে, সামনে মিলনস্বর্ণ। | ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সহিত এইবার হাত মিলাইয়া মুক্ত, আলাে-ছায়ার পথে। একব্রত সাথী হইয়া চলিয়াছে, তাহা নিশ্চয়ই ঐতিহাসিক সত্যে সমাদৃত এক মিলন-স্বর্গ রচনা করিবার। প্রয়াস। ভারতের জীবন যে গণতান্ত্রিক আদর্শে দীক্ষিত হইয়াছে, বীর পুন্যাত্মা মুজিবরের বাংলাদেশও সেই গণতান্ত্রিক আদর্শের দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছে। ইহা দুই ভিন্ন আদর্শের নিতান্ত সহ-অবস্থিত মিলন নহে, দুই সমআদর্শের সহৃদয় আলিঙ্গন। এই মিলন-স্বর্গের সিংহদ্বারের কাছে ধুলির উপর মুখ থুবড়াইয়া পড়িয়া থাকিবে যে বস্তুটি, তাহা হইল পাকিস্তানের শব; তাহা গলিয়া পঁচিয়া কয়েকদিনের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইবে। আজ আর কাহারও পক্ষে বেশী গবেষণা করিবার প্রয়ােজন হইবে না। ঘটনার ছবিটিকে মনশ্চক্ষে একেবারে স্পষ্ট করিয়া দেখিতে পাওয়া যাইতেছে যে, যে-অত্যাচারী বৈরী মুক্তিবাহিনীর একনিষ্ঠ অস্ত্রের আঘাতে নির্জিত হইয়া আসিয়াছিল তাহার হৃৎপিন্ড এইবার বিদারিত হইয়া চরম অন্তিম বরণ করিবে। এই পবিত্র কর্তব্যে ভারতের কিছু করণীয় ছিল। আশা করা যায়, এইবার তাহা যথােচিত নিষ্ঠার সহিত প্রতিপালিত হইবে। বাংলাদেশে সশস্ত্র পাকিস্তানী শত্রুর উপরে শেষ আঘাত হানিবার কী পদ্ধতি হইবে, তাহা বিচার করিয়া বুঝিবেন ও করিলেন মুক্তিবাহিনী এবং সহযােগী ভারতীয় বাহিনী। মনে হয়, তাহাদিগকে স্মরণ না করাইয়া দিলেও চলিবে যে, বাংলাদেশে অবস্থিত সমগ্র পাকিস্তানী বাহিনীকে নির্জিত করিবার সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের অবরােধ কঠোরভাবে সম্পন্ন করিয়া ফেলিতে হইবে।
শত্রু যেন পালাইবার সুযােগ না পায়। বন্দর অবরোধ। করিয়া এবং বিমানপথ মৃত্যুসফুল করিয়া পাকিস্তানী বাহিনীকে বাংলাদেশেই অবরুদ্ধ করিয়া রাখিতে হইবে। বঙ্গবন্ধু মুজিবর পশ্চিম পাকিস্তানের এক গােপন কারাগারে পড়িয়া আছেন। হাজার-হাজার বাঙালী পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে নিদারুণ আটক অবস্থার দুর্ভাগ্য সহ্য করিতেছেন। ইহাদিগকে ইয়াহিয়ার পাকিস্তান মুক্ত করিয়া দিয়া স্বদেশে ফিরিবার সুযােগ প্রদান করিলে তবেই বাংলাদেশের অবরুদ্ধ পাকবাহিনীকে এবং অন্যান্য অজস্ৰসংখ্যক পশ্চিম-পাকিস্তানীকে নিজ দেশে ফিরিয়া যাইবার সুযােগ দিতে পারা। যাইবে। নচেৎ নহে। এক কোটি শরণার্থী যাহারা পাকিস্তানী শত্রুর সশস্ত্র বিভীষিকা ও নির্যাতন হইতে রক্ষা পাইবার চেষ্টায় ভারতে আশ্রিত হইয়াছেন, তাহারা নিশ্চয় শুনিতে পাইতেছেন যে, দেশের নদীর মায়াময় জলকলস্বর তাঁহাদিগকে এইবার ব্যাকুল হইয়া ডাকিতেছে। ফিরে এস ঘরে পরবাসী। ইহাও সামনের মিলন-স্বর্গের একটি
৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা