You dont have javascript enabled! Please enable it!

আন্তর্জাতিক চক্রান্ত

ব্যবধান চব্বিশ ঘণ্টার, শ্রীমতী গান্ধী পর পর দুইদিন ভারত-আত্মার বাণী মূর্তিটি ব্যক্ত করিয়াছেন। দ্বিতীয় দিনের ভাষা কঠোরতর। লক্ষ্য একই-পাক বান্ধব সমিতি, তথা আন্তর্জাতিক চক্রী-চক্র। জাতীয় স্বার্থে আমাদের যাহা উচিত তাহাই করিব- ঠিক এইভাবে সবার উপরে জাতীয় স্বার্থ, এই সত্যটি ইতিপূর্বে বােধহয় উচ্চারিত হয় নাই। হাজার হাজার মাইল দূর হইতে যখন “নেটিভদের উপর হুকুমজারি করা চলিত, সেইদিন আর নাই, প্রধানমন্ত্রী ঘােষণা করিয়াছেন। সেই সঙ্গে এই কথাও যে, আমাদের ভৌগলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব আমরা বিসর্জন দিতে পারি না। যেমন সুখকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হইয়াছি, প্রয়ােজন হইলে, তেমন ভাবেই সখ্যকেও বিসর্জন দিব। ভাষণের প্রধান লক্ষ্য ছিল ব্রিটেন, অন্যতম লক্ষ্য অবশ্যই নাটের গুরু আমেরিকা। শ্রীমতী গান্ধী হয়তাে বুঝিয়া থাকিবেন, তাহার সাম্প্রতিক সফরে যেটুকু সদিচ্ছা সঞ্চারিত হইয়াছিল, তাহা সহসা কপূরের মতাে উবিয়া গিয়াছে। দুই দেশের সরকারি মনােভাব কোনদিনই ভারতের প্রতি অনুকূল ছিল না, কিন্তু এদেশের পক্ষে ছিল ওই দুই দেশের “প্রেস” অর্থাৎ সংবাদপত্র। কেননা বিদেশি সাংবাদিকেরা অনেকেই জঙ্গীশাহীর আক্রোশের শিকার হইয়াছেন, গণউৎসাদনের বিংশশতকী সংস্করণের অনেকেই প্রত্যক্ষ সাক্ষী। মর্মন্তুদ বিবরণে আর ছবিতে বিদেশি পত্রপত্রিকার পাতাগুলি একদিন ছাইয়া গিয়াছে। এমতে প্রভাব বিস্তারের জন্য সেগুলিই ছিল প্রধান সম্বল। বলিতে কি, পাক প্রেমিক রাষ্ট্রশাসকদের ওই জনমতই কতকটা রাশ টানিয়া রাখিয়াছে।  সেই বিদেশী “প্রেস” হঠাৎ যেন ডিগবাজি খাইয়া গেল। কেন, কারণ রহস্যাবৃত। এই দশকের সবচেয়ে নৃশংস হিংসার প্রকাশ, রাজনৈতিক ও মানবিক সব মেলি নীতির উদ্ভব দলন, আগ্রাসনের আস্ফালন- সব প্রমাণও নমুনা কি পলকে মিথ্যা হইয়া গেল? এ এক প্রহেলিকা।

সরকারি সানাইয়ের সুরে বিদেশি পত্রিকাগুলি পোঁ ধরিয়াছে, তার মাসে আসল পরীক্ষা ও সঙ্কটের সময় কায়েমী স্বার্থের আন্তর্জাতিক ট্রাস্টিদের স্বরূপ বাহির হইয়া, সব শিয়ালেরই এক “রা” আর রক্ত ঘন জলের চেয়ে। | স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে গণতন্ত্রের এই যে রক্ত-সম্পর্ক, এও এক তাজ্জব ব্যাপার। অসবর্ণ মিলন, কিম্ভুত এক বর্ণসঙ্কর আচরণ, প্রসব করিতেছে। প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বলিয়াছেন- চিরকাল যাহারা দুনিয়া জুড়িয়া পরের ভিটায় ঘু ঘু চড়াইয়া বেড়াইল, তাহারাই আজ উটের মতাে গ্রীবা তুলিয়া “ভারত অন্য দেশের ব্যাপারে নাক গলাইতেছে,” বলিয়া সসারগােল তুলিয়াছে। সুয়েজে ব্রিটেনের ভূমিকা তবে ছিল কী, কিংবা কিউবার সেইদিন আমেরিকার? এবং আজও ভিয়েতনামে মার্কিন শক্তি কোন্ পবিত্র সনদের জোরে হাজির আছে? পাক সৈন্যরা যখন ভারত সীমান্তে আসিয়া থানা গাড়িল তখন কেহ টু শব্দটি করে নাই, আর ভারত যেই আত্মরক্ষার জন্য পাল্টা ব্যবস্থা লইয়াছে অমনই ছি-ছি-কার, আর ধিক্কার । ডবল স্ট্যানডার্ডের শঠতা ইহার চেয়ে দূরে যাইতে পারে না। বালুরঘাটে গােলা আর আগরতলায় বােমা বর্ষণের পরেও আন্তর্জাতিক মুরুব্বিরা নীরব কেন? ইহার। মধ্যেও বুঝি তাঁহারা ভারতের আগ্রাসী মনােভাবের নমুনা দেখেন? | যাহাকে দেখিতে নারি তাহার চলন বাঁকা- ইহাই আসল কথা। সাম্রাজ্যবাদীরা কোনওদিন ভুলিতে পারে। নাই কোন্ অবস্থায় তাহাদের একদিন ভারত ছাড়িয়া যাইতে হইয়াছিল। আজ পিণ্ডির শাসক ও শােষকদের উপর যখন বাংলাদেশ ছাড়ার নােটিশ জারি হইয়াছে, তখন তাহাদের সেই স্মৃতি উথলিয়া উঠিয়াছে। সেদিন তাহারা পার্টিং কিক হিসাবে একদা এক অখণ্ড দেশকে দিয়া যায় পাকিস্তান। সেই প্রসবের ধাত্রীরা আজ অপজাত সেই দৃষ্টিটির শ্মশানবন্ধু হইতে চট করিয়া রাজি হইতে চাহে না। কিন্তু হইতেই হইবে, ইতিহাসের ঘড়ির কাঁটা অমােঘ রীতিতে ঘুরিয়া চালিয়াছে। ১৯৬৫-সনে উইলসন সাহেব ভারতকে আগ্রাসক বলেন, আজও ইংল্যান্ডে সেই সাবেকী সুরেরই প্রতিধ্বনি। রক্ষণশীল “ডেইলী টেলিগ্রাফ” এদেশকে গালি পাড়িয়াছে। তাহার সঙ্গে সুর মিলাইয়াছে তথা কথিত উদার নৈতিক “গার্ডিয়ান।” এই পত্রিকাটি বলিতেছে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী নাকি সুর বদলাইয়াছেন।

বদলাইয়াছে কে, সেটা জিজ্ঞাসা। করিলেও চলে, আগামীকালের জন্য তাহা জমা রহিল। অথচ এই পত্রিকগুলিই কিন্তু কিছুদিন আগেও ভারতীয় সংযমকে প্রশস্তিবাক্যে ভরিয়া দিয়াছিল। মূল বিষয়টির কেহ ধার কাছ দিয়াও যাইতেছে না। মূল কথাটা মার্চ মাসে ইয়াহিয়া শাহীর দ্বারা সর্বৈব । গণতান্ত্রিক রীতিনীতির উপর বলাঙ্কার। অথচ এই দেশগুলিই নাকি কেহ ফ্রি ওয়ার্ল্ড-এর মাতব্বর কেহ বা দুনিয়াকে সংসদীয় গণতন্ত্র উপহার দিয়াছে বলিয়া বড় বড়াই করে। ইহার পর তাহাদের মুখ তাে মুখ, নগ্নতা। ঢাকিবার জন্য ডুমুর পত্রটিও অবশিষ্ট রহিল না। ভারতের উপরেও যে তিন তিনবার পাক আক্রমণ হইয়া। গিয়াছে, একথা ইহারা অনায়াসে ভুলিয়া যায়, এত বিদেশী প্রতিনিধি এতবার সরেজমিনে সব পর্যবেক্ষণ করিয়া গিয়াছেন, তবু ইহারা রাষ্ট্রপুঞ্জের পর্যবেক্ষক বাহিনী মােতায়েনের অবদার জানায়। প্রত্যেকেই যদি তর্জনী তুলিয়া আজ শাসাইয়া থাকে, তবে প্রধানমন্ত্রী যেন বৃদ্ধসুষ্ঠ তুলিয়া উপযুক্ত জবাব। দিয়াছেন । অতীত তিক্ত অভিজ্ঞতা বলে বিশ্বাস নাই কাহাকেও-রাষ্ট্র পুঞ্জকেও না। এই বাস্তব জ্ঞান আমাদের আগামী দিনে পথ দেখাইবে। মার্কিন কাগজ “নিউইয়র্ক টাইমস ভারতকে বলিয়াছে বিপথগামী, মার্কিন । শাসক গােষ্ঠীর “নিঃশব্দ কূটনীতির তারিফ করিয়াছে। এই নিঃশব্দতা নিতান্ত নিরীহ নহে, ইহা অত্যন্ত। ধূর্ত, কপট ও শঠ । শ্রীমতী গান্ধী তাহার ভাষণে অনেক কথাই খােলাস করিয়া বলিয়াছেন, শুধু বলেন নাই যে, গত নির্বাচনের পর এই দেশে যে রাজনৈতিক স্থায়িত্ব ফিরিয়া আসিয়াছে, বিজয়িনী ইন্দিরাজী তাহার । শীর্ষে, তাহাকে ইহারা কেহ সুনজরে দেখিতেছে না। কেননা ভারতের রাজনৈতিক স্থায়িত্ব তাহার ভবিষ্যৎ শক্তির ভরসাও বটে। শক্তিমান ভারতকে ইহারা বরদাস্ত করিতে চায় না। মাত্রাছাড়া পাক প্রেমের মূল। রহস্যের ইহাও একটা; এবং ভারতের স্থায়িত্ব নষ্ট করার জন্য সেই হেতুই এই দলবদ্ধ আন্তর্জাতিক চক্রান্ত।

৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!