You dont have javascript enabled! Please enable it!

শেষ লড়াই  বেশ এই শেষ

যুদ্ধ- এই উপমহাদেশের দুই শরিকের মধ্যে পুনর্বার, এই লইয়া চতুর্থবার । জঙ্গী পিণ্ডির “লড়কে লেঙ্গে” রা অবশ্য বলিতেছে “যুদ্ধবস্থা”। অর্থাৎ কথার একটু মারপ্যাচ, নামমাত্র একটা আড়াল, ঘােমটার তলায় খেমটা। বড় বড় বাবুদের পেয়ারের বাইজী ভাবিয়া থাকিবে, তাহা হইলে চারিদিক হইতে বিস্তর তালি আর প্যালা মিলিবে । কিন্তু যুদ্ধ যুদ্ধই। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতিকে সেটা হুশ করাইয়া দিয়াছেন। “ক্রা ইন্ডিয়া, ক্রাশ ইন্ডিয়া” বলিয়া যাহারা এতদিন ক্রমাগত দন্ত কিড়িমিড় করিয়াছে, এই মুহূর্তে তাহারা সব বিষ, লালা আর হৃদয়ের লালসার জ্বারা লইয়া আমাদের উপর ঝাপাইয়া পড়িয়াছে। শুক্রবার পাঁচটি রাজ্যের আটটি এলাকায় হাওয়াই হামলা লড়াইয়ের ঘণ্টাটা বাজাইয়া দিয়াছে। ওয়ার্নিং বেল অবশ্য আগেই পড়িয়াছিল-বয়ড়া-আর  আগর তলার আকাশে হানায়, বালুর ঘাটে বাদলের বারিধারা প্রায় গােলায় । ভারতীয় নাগরিকদের রুধিরে ভারতের মাটি ভিজিয়াছে। জবাবে আমাদের জওয়ানেরা আগাইয়া গিয়াছেন। লক্ষ্য শত্রুর ঘাটিগুলি- প্রতিরক্ষার জন্য প্রত্যাঘাত। দন্তের আর ষড়যন্ত্রের দুর্গগুলিকে উড়াইয়া দিতে হইবে। হামলার বদলে হামলা। স্থলে জলে অন্তরীক্ষে ভীষণ নির্ঘোষ, দুর্জয় প্রতিজ্ঞা স্পর্ধার চ্যালেঞ্জের যােগ্য উত্তর দিয়া চলিয়াছে। জওয়ানদের নিঃশ্বাসে আগুন, প্রাণে মাতৃভূমিকে রক্ষা করার পবিত্র শপথ দৃঢ়মূল- আমাদের বিমানবহর তাহাদের মাথায় ছাতা মেলিয়া ধরিয়াছে।  বারবার চারবার । ইতিহাসের দেবতা ভারতকে আবার এক অগ্নীপরীক্ষা; অগ্নীস্নানে পরিশুদ্ধির মুখােমুখি করিয়া দিলেন। দুঃখের পানে অর্জিত স্বাধীনতা বুঝি আরও কঠোরতর পণ চায়। সে শুল্ক দিতে হইবে তাহার নাম আত্মত্যাগ, তাহার নাম সাহস, তাহার নাম জাতীয় একতা। 

সেই সঙ্গে সম্ভবত অসীম সহিষ্ণুতাও। প্রধানমন্ত্রী কোনও সহজিয়া বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দেন নাই। দীর্ঘদীর্ঘ সংগ্রাম তাহার কথা। গত আট মাস ছিল কঠোর সংযমের মাস। দুনিয়ার দুয়ারে দুয়ারে ভারত একটি সমাধানের আবেদন লইয়া ফিরিয়াছে। তাহার বক্তব্য ছিল একটাই ইয়াহিয়াশাহী নিজের ঘর পােড়াইয়াছে, এখন সে লেজের আগুনে ভারতকে ছারখার করিতে চায়। ভারত বলিয়াছে- দোহাই আপনাদের, ক্ষিপ্ত শ্বাপদকে সামলান, উন্মাদকে নিবৃত্ত করুন। সে প্রার্থনায় কেহ কর্ণপাত করেন নাই। কিন্তু এবার বােধ হয় দুনিয়াদার দোকানদারেরা নিক্তি লইয়া ওজন করিতে বসিবেন আর ধূর্ত মিটমিটে চোখে চাহিয়া দেখিবেন, কাটা কোন দিকে হেলে । “থামাে থামাে” চিঙ্কার উঠিতেও বাধা নাই। কিন্তু এবার আর পুরানাে ভুলের পুনরাবৃত্তি নয় । চাপে বা অনুরােধে সুচাগ্র মেদিনীও ছাড়া নয়। কেননা প্রমাণ হইয়া গিয়াছে ইয়াহিয়া কিংবা তাহার ইয়ার ভুট্টো ভাষা বােঝেন মাত্র একটি-অস্ত্রের ভাষা।  “ভারতকে খতম কর”, এই রণধ্বনি মুখে লইয়া উল্লসিত জল্লাদেরা পুবের জ্বলন্ত মশাল পশ্চিমেও লইয়া গিয়াছে। ইয়াহিয়া ফাক পাইয়া বলিয়াছেন, দোস্তরা আমাদের সঙ্গেই আছে। পিঠ চাপড়ানাে আর কাঁধে কাঁধ মিলানাে কিন্তু এক নয়। ভরসাটা ততখানি খাটি সেটা জানে একমাত্র পিকিং। ভারতও আজ নির্বান্ধব নয় । সােভিয়েটের সঙ্গে চুক্তির ধার কত, এবার তাহারও পরখ হইয়া যাইবে। যাচাই করার সময় আসিয়াছে। মিত্রতার যাত্রা হাত মিলাইয়া চলুক জয়ের পথে। এবার আমাদের আরও এক মিত্র বাংলাদেশ গতকাল অবধি যে ভূভাগ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অংশ, তথা কলােনি। ভারত আজ নির্বান্ধব নয়, তার চেয়েও বড় কথা, এ-ভারত সে-ভারত নয়- জঙ্গীশাহী সেটা অবিলম্বে টের পাইবে হাড়ে হাড়ে।

এ অন্য-ভারত, গত পাঁচ বছরে যাহার অন্তরে বাইরে ব্যাপক পরিবর্তন হইয়া গিয়াছে। পাকিস্তানের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করিতে মুহূর্তে উথিত হইয়াছে একটি জাতি, হাসিমুখে আপকালীন ব্যবস্থা মানিয়া লইয়াছে, সব দল সরকারের পাশে, সাধারণ মানুষ জওয়ানদের পিছনে। তাহাদের শুধু একটি প্রশ্ন কবে কতদিনে? এই যুদ্ধের নৈতিকতা লইয়া কোনও তর্ক, কোনও সংশয় নাই। কিন্তু এ যুগের যে লড়াই, তাহা শুধু জওয়ানেরা লড়ে না। লড়িতে হয় প্রত্যেককে, গুহাঙ্গনও একটি ফ্রন্ট। সেখানে অটুট সংহতি, সংযম ও স্থিতি চাই। ঐতিহাসিক এই সঙ্কটে তােলা থাক যত ভেদবুদ্ধি, সঙ্কীর্ণতা, হানাহানি আর রেষারেষি। অক্লান্ত পরিশ্রম, অজস্র উৎপাদন, এই মন্ত্রে জাতি উদ্বুদ্ধ হইয়া উঠুক; ছােট স্বার্থ, তুচ্ছ ঈর্ষা, যা খুশি করার, যা খুশি বলার, থামিয়া থাকার আর থামাইয়া রাখার আবিল নেশা আর অভ্যাস প্রবল আবেগের প্লাবনে ভাসিয়া যাক। অস্তিত্বের এই বিপন্ন প্রদোষে, চরম সঙ্কটের ক্ষণে ঐক্যই আমাদের পরম প্রাপ্তি, কঠিন ব্রত উদ্যাপনে কোনও বিভেদী বিলাস সাজে না। পিণ্ডির মসনদ হইতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া হুমকি দিয়া বলিয়াছেন, “এবারের সংগ্রামই হইবে শেষ সংগ্রাম” তাহাকে বলিঃ “এই হুমকিটা আপনার পক্ষে কত অনভিপ্রেত অর্থে সত্য হইতে পারে, খান সাহেব, আপনি জানেন না। ফুলচন্দন পড়ুক আপনার মুখে; না জানিয়া হয়তাে একটা সত্য ভবিষ্যদ্বাণী করিয়া বসিয়াছেন। শেষ লড়াই? জরুর, জরুর, শেষ বৈকি। কারণ এই লড়াই এর শেষে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিই শেষ হইয়া যাইতে পারে, অন্তত তাহার এই চেহারাটা আর আস্ত থাকিবে না।”

৫ ডিসেম্বর ১৯৭১, আনন্দবাজার পত্রিকা

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!