খাঁ সাহেবের খয়ের খাঁ
জবরজঙ্গী ইয়াহিয়া খাঁর সেই সদম্ভ দাবির কথা কেহ ভুলিয়া যায় নাই। এক হাতে ঢাল অন্য হাতে তলােয়ার, পাকিস্তানের এই খাঁ সাহেব কিছুকাল আগেই রীতিমত উচু গলায় জানাইয়া ছিলেন যে তিনি নাদির শাহের বংশধর । কথাটা সত্য কিনা, কিংবা লতায় পাতায় কতটা সত্য, তাহা লইয়া তর্ক বৃথা। আপাতত এইটুকুই লক্ষনীয় যে নাদির এবং ইয়াহিয়ার চরিত্রে পারিবারিক মিল অনেকখানি-দুজনেই সমান নিষ্ঠুর এবং সমান হিংস্র। ইতিহাসের পাতার উপরে এই দুইজনই সমানে রক্তবন্যা বহাইয়া দিয়াছেন; পূর্বপুরুষ নাদিরের। তুলনায় উত্তরপুরুষ ইয়াহিয়ার হাতে নিশ্চয় রক্তের দাগ কম লাগে নাই। বস্তুত সেদিক হইতে বােধহয় বিশ শতকের এই বংশধরটি তাহার অষ্টাদশ শতকের পূর্বপুরুষকেও টেক্কা দিয়াছেন। এবং সেই বিচারে অবশ্যই বলা চলে যে, বংশ লতিকার সন্ধান লইয়া লাভ নাই, আদৌ যদি এই মানুষটি কাহারও বংশধর হন, তবে নিশ্চয় নাদির কিংবা অনুরূপ কোনও খুনী লুঠেরারই বংশধর আর কাহারও নয়। বলা বাহুল্য কুকীর্তিমান কোনও মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের কথাটা অস্বীকার করা না যাক- জাক করিয়া বলা চলে না। গৌরবে গলা উঁচু করিয়া শুধু তাঁহাদের সঙ্গে সম্পর্কের কথাই ঘােষণা করা যায়, মানুষের কল্যাণ করিয়া মানুষেরই ইতিহাসে যাহারা অমর হইয়া আছেন। ইয়াহিয়া যাহাই বলুন, বাংলাদেশের একজন রাজনীতিক কিন্তু গৌরবজনক সম্পর্কের কথাই সম্প্রতি শুনাইয়াছেন। ইয়াহিয়ার প্রতিনিধি হিসাবে সম্প্রতি যিনি সিংহলে গিয়েছেন, সেই রাজা ত্রিদিব রায়ের বক্তব্য ঃ তিনি শাক্যমুনির মাংশধর। রায় মহাশয়কে সকলেই চেনেন। পূর্ববঙ্গের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া মাত্র দুইজন প্রার্থী জিতিতে পারিয়াছিলেন; তিনি সেই মানিক জোড়েরই একজন। আপাততঃ বিদেশে গিয়া বলিয়া বেড়াইতেছেন যে, পাকিস্তান তাে পূর্ববঙ্গে শান্তি স্থাপন করিতেই চায়; নিতান্ত ভারতবর্ষের জন্যই সেটা সম্ভব হইতেছে না।
অজুহাত দেন তবে বলিতে হয় এমন অজ্ঞকে দিয়া আর যাহাই হােক এত বড় দেশের প্রতিনিধিত্ব চলে না।। টাসকানির ডিউক একবার ভেনিসীয় দূতের কাণ্ড দেখিয়া নাকি মন্তব্য করেন নির্বোধ তাে আমাদের দেশেও আছে, কিন্তু আমরা তাহাকে অন্য দেশে চালান করি না। শ্রী অটলকে ফিরাইয়া আনিয়া সাউথ ব্লকের একটা। চেয়ারে বসাইয়া দেওয়া যায় না? সংসদের পীড়াপীড়ীতে পড়িয়া শ্রী স্বর্ণ সিং ভারতীয় নীতি আবার ঘােষণা করিয়া ভালই করিয়াছেন। নতুবা চতুর্দিকে গবেষণার রসনাগুলি লক্লক্ করিয়া উঠিত। রাজনীতিক সমাধানের ইয়াহিয়া খা যে তামাসা চালাইতে চাহেন প্রকাশ্যে না তুলেও আড়ালে তাহার বিস্তর খরিদ্দার। শ্রী অটলের বিবৃতিকে তাঁহারা কাজে লাগানাের মতলবে লাগিয়া যাইতে পারেন। শ্রী স্বর্ণ সিং বলিয়া দিয়াছেন, বিবৃতিটি ভারতের কণ্ঠস্বর নহে।। এ দেশের সিমান্তের কোনও নড়চড় নাই। বাংলাদেশের উপনির্বাচনকে ভারত স্রেফ ধাপ্পা বলিয়া মনে করে, ইয়ার বকসীদের লইয়া ইয়াহিয়া যে বয়স্যসভা পরিতে চাহেন ভারত তাহাকে স্বীকার করে না। গত বৎসরের নির্বাচনে যাঁহারা জয়ী হইয়া ছিলেন ভারতের মতে তাঁহারাই গণপ্রতিনিধি এবং তাহাদের বাদ দিয়া কোনও রাজনৈতিক সমাধান নাই ।
এই বিবৃতির দরকার ছিল, নহিলে পাঁচজনে ঠাওরাইয়া বসিতঃ ভারতও বুঝি পুতুল সরকারের অপেক্ষায়। এই পুতুল সরকার ডিসেম্বরের মধ্যেই পয়েদা হইবে বলিয়া ইয়াহিয়া অগ্রিম নােটিশ দিয়া রাখিয়াছেন। সাফ সাফ কথা বলিয়া শ্রী স্বর্ণ সিং সরকারি নীতিতে না হয় সাফসুরং করিয়া রাখিলেন, সংসদ সদস্যদের জেরাও না হয় ঠেকানাে গেল, কিন্তু ইহার পরও শ্রী অটল কি ইসলামাবাদের দূতাবাসটি আগলাইয়া রহিবেনা সরকার এখনও শ্রী অটল কথিত সমাচারের পুরাে বয়ান দেখেন নাই। তবে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেও যখন প্রামাণিক বিবরণ মিলিল না তখন বয়ানের সম্পাদন এবং দুই চারিটা র বাহির করা এমন কি শক্ত হইবে? প্রথম প্রশ্ন। শ্রী অটল ‘অ্যাট অল’ কথাগুলি বলিয়াছিলেন কিনা, বলিয়া থাকিলে ঠিক ঠিক কী বলিয়াছিলেন। দ্বিতীয় প্রশ্ন, সরকারের সম্মতি না লউন, অন্তত মনােভাবের আন্দাজ না লইয়াই তিনি কথামৃত ছড়াইয়াছেন ইহা সম্ভব কিনা, সরকারি অস্বীকৃতি একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপারকে বিশ্বাস করাইতে চাহিতেছে। মতামত ব্যক্তিগত” হইলেও তাহা বিতরণের সাহস একজন রাষ্ট্রদূতের আসে কোথা হইতে? শুধু সংসদে অস্বীকৃতিতে কুলাইবে না; রহস্যটা খােলসা করিতে চাই শ্রী অটলের তলব- দুইটাই। নাহিরে পাকিস্তানের মামা মেশােদের প্রচারেরই পােয়াবারাে। কমিটেড ব্যুরােকেসির’-র কথা ইদানীং প্রায়শ শােনা যায়। কিন্তু কমিটেড কূটনীতিক বলিয়াও একটা শ্রেণী গড়িয়া উঠিয়াছে নাকি? যদি উঠিয়া থাকে তবে, এই সঙ্কটের ক্ষণে, তাহার অস্তিত্ব ভয়ংকরতর।
১ ডিসেম্বর, ১৯৭১ আনন্দবাজার পত্রিকা
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮