স্বৈরতন্ত্রী জমানার ‘গণতন্ত্রী’ মুরুব্বি
ফিরিবার পথ নাহি।- এই কথা বলিয়াছেন পাক জঙ্গীতন্ত্রের মহামােহন্ত ইয়াহিয়া খান । দূর ইসলামাবাদ হইতে চাহিয়া তাহার মনে হইয়াছে পরিস্থিতি এমনই। ফিরিবার পথ নাহি । কিন্তু একথা জঙ্গী নায়কের খেয়াল ছিল না। যখন তিনি ক্ষিপ্ত আক্রোশে আগাইয়া আসিয়াছিলেন, সাড়ে সাত কোটি মানুষের দেশকে পদতলে দলিত করিতে, এবং পাশের দেশকে শিক্ষা দিতে। সেদিন স্পর্ধা ও বিদ্বেষে অন্ধ তিনি বােঝেন নাই যে, ফিরিবার পথ থাকিবে না। যে অরণ্যে রাস্তা হারাইয়া ফেলিয়াছেন দিশাহারা ইয়াহিয়া খান, সে অরণ্যের কুটিলতা ও বিভীষিকা তাহারই তৈয়ারী। তাহার বুকে ছিল লালসা আর তাহার ও তুলায় মনে মনে ছিল মুরুব্বিদের ভরসা। এইবার খতাইয়া দেখা যাক মুরুব্বি কে অথবা কে কে। বেসামাল ইয়াহিয়া খান সাবেকি মনিব ব্রিটেনের দুয়ারে ধর্ণা দিয়া পড়িয়াছেন। আর্জি- “আমাকে এই কালাবদর পার করিয়া দাও।” কিন্তু এবে বুড়াে ব্রিটেনের ভূমিকা হাল দুনিয়ার গাওনার মজলিসে দোহারের বেশি কিছু নয়। সাধ থাকিলেও তাহার সাধ্য নাই । মুরুব্বি মার্কিন “যেদিকে যাইবে, সেও কাছা ধরিয়া সেই দিকেই ছুটিবে, রাষ্ট্রপুঞ্জের খবরদারির প্রস্তাবে ব্রিটেন বড়জোর “আমি সমর্থন করি।” এই পর্যন্ত বলিতে পারে, আর কিছু না। বাকি রহিল আমেরিকা, রাশিয়া, চীন ও ফ্রান্স। আমেরিকার কথা পরে আপাতত দেখা যায় রাশিয়া আরও একবার ইসলামাবাদী লড়কে লেঙ্গে ওয়ালাদের ধমকাইয়া দিয়াছে; তাহার সহানুভূতি কোন্ দিকে সেটা স্পষ্ট। পিকিংয়ের মতিগতি অবশ্য তেমন স্পষ্ট নহে। একদিক শরণার্থীদের জন্য কম্বল পাঠানোয় খানিকটা মানবিক হৃদ্য উত্তাপের পরিচয় মেলে; আবার অন্য দিকে রাষ্ট্রপুঞ্জের সামাজিক কমিটিতে চৈনিক প্রতিনিধি নাম না করিয়া ভারতকে ঠারে ঠারে বিস্তর গালিগালাজ করিয়াছেন। তথাপি মনে হয়, চীনে যে প্রহেলিকা ছিল, সেই প্রহেলিকাই আছে।
নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের হইয়া ওকালতি করিবে, সে এমন কথা এখনও কবুল করে নাই। তথাপি ইয়াহিয়া খান ধরিয়া লইয়াছেন যে, পিকিংয়ের পূর্ণ সমর্থন মিলিবেই । শ্ৰী টু এন-লাই, বিশ্বের আর পাঁচজন মােড়লদের সঙ্গে গলা মিলাইয়া উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছেন, এই মাত্র। ইহাতে সমর্থনের কোনও শপথ নাই । ফ্রান্সও, যতদুর দেখা যায়, এ পর্যন্ত নিরপেক্ষ, বরং ইদানীং তাহার প্রীতি মােটামুটি বাংলাদেশের অত্যাচারিত জনগণের প্রতি। এইবার নাটের গুরু আমেরিকা। তাহার যে টনক নড়িয়াছে ইহাতেই বােঝা যায় আমেরিকার বড় পেয়ারের ইয়াহিয়াচক্র পড়িয়াছে বেকায়দায়। আমাদের সীমান্তে এবং সীমান্তের ওপারে এমন যে সংকট তাহার দুইটি দিক। দুইটাকে এক সঙ্গে মিলাইয়া ফেলা কূটনৈতিক শঠতা। সীমান্তের ওপারে সুসংহত, প্রতিজ্ঞারূঢ় মুক্তিবাহিনী অবিরাম আগুয়ান, সাফল্যের পর সাফল্য তাহার আয়ত্তে। বেকায়দায় পড়িয়া পাক জঙ্গীশাহী ভারতকে যুদ্ধে জড়াইয়া ফেলিয়া তাহার বদলা লইতে চায়। এই ঘাের সঙ্কটে যে জাতি ভারতকে বলে “সীমান্ত হইতে সৈন্য সরাইয়া লও”, সে ভারত-বিদ্বেষী, অন্তত হিতৈষী নহে। আরও খানিকটা জমি পাক জমানার ঘরে জমা না দিতে পারিলে বুঝি পিণ্ডির মুরুব্বিপ্রবরের সুখ নাই? লড়াই যদি বাধেই তবে সে লড়াই হইবে বাঁচার লড়াই চলতি শ্লোগানটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য হইয়া উঠিবে। দেশরক্ষার জন্যই দেশরক্ষী বাহিনীকে দরকার হইলে দেশের সীমানা ডিঙ্গানাের হুকুম দেওয়া হইয়াছে। আমেরিকা তাহা যে বােঝে না এমন নহে। কী করিত মার্কিন মুলুক যদি তাহার সীমান্তবর্তী কোনও পরদেশ প্রথমে কোটি খানেক শরণার্থী দিত পাঠাইয়া-এবং পরে মার্কিন নাগরিকদের তাক করিয়া তােপ দাগিতে থাকিত। এ জানিয়া শুনিয়া দরদী পিসিমার নামাবলি জড়াইয়া ইষ্টমন্ত্র জপ করা ন্যাকামির চূড়ান্ত। ভারত এই নিরামিষী পরামর্শে কান দেয় নাই; দিতে পারে না; ফাঁদে পা দেয় নাই, দিতে পারে না। কেননা এই সন্ধিক্ষণে প্রতিটি সিদ্ধান্ত ভারতের অস্তিত্ব ও জীবনমরণের সঙ্গে জড়িত। নিক্সন এ্যান্ড কোং-কে বরং বলি, এই ভালমানুষির ফোপরদালালি ছাড়িয়া, তাঁহারা যদি পারেন তবে ইয়াহিয়া সম্প্রদায়কে ভাল হওয়ার পরামর্শ দিন, যেটুকু চাপ আছে, তাহা প্রয়ােগ করুন।
একটা স্বৈরতন্ত্রী সরকার গায়ের জোরে মানবতার উপর বলাক্তার চালাইয়া যাইবে, আর যাহারা মুরুব্বি তফাতে দাড়াইয়া কেবল “আহা আহা” বলিবে, এ হয় না। এই “আহা আহা” আসলে “বাহা বাহার নামান্তর। আঙ্কারা পাওয়া পাক জমানা এতটুকু পােষ মানে নাই, আমেরিকার মিনতিতেও আজ অবধি মুজিবকে মুক্তি দিল না- রাজনৈতিক সমাধান তাে দূরের কথা। আসলে আমেরিকা জড়াইয়া পড়িয়াছে তাহার নিজেরই- আর্মস পলিসির কূটজালে। “সেন্টো” “সিয়াটো”র হাতিয়ার আন্তর্জাতিক কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়িয়া তােলার এতটুকু কাজে লাগে নাই, বরং গণতন্ত্রী ভারতের উপর দিয়া তাহার চোট যাইতেছে, আর গণতন্ত্রের সেবায়েত আমেরিকা সবই সহিতেছে। সহিতেছে বলিলে ভুল হইবে; আজ সরাসরি অস্ত্র দাদন মূলতুবি রাখিয়াও খিড়কির পথে ভিয়েৎনাম হইতে যে হাতিয়ার জোগানাে হইতেছে না তাহাই বা হলপ করিয়া কে বলিবে? গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী হইয়াও অত্যাচারী স্বৈরতন্ত্রের খােলাখুলি এই যে দালালি ইহা আত্মখণ্ডন, ইহা পাপ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ । যে-কমিশন এই দালালির প্রাপ্য তাহা ভােলা থাকিতেছে। আজ না-হােক, আগামী কোনও দিনের হিসাবে সেটা আমেরিকাকে কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়া লইতে হইবে।
২৭ নভেম্বর, ১৯৭১, আনন্দবাজার পত্রিকা
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮,